বাংলাদেশের মাথাপিছু বা পার ক্যাপিটা জিডিপি অচিরেই ভারতের ফিগারকে টপকে যাবে, আইএমএফ তাদের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে এই পূর্বাভাস করার পর তা নিয়ে ভারতে বিতর্ক যেন থামতেই চাইছে না। খানিকটা পরোক্ষভাবে এবার এই বিতর্কে ঢুকে পড়লেন কিংবদন্তি ভাষ্যকার ও বিবিসির সাবেক সাংবাদিক মার্ক টালি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যার আত্মীয়তা নিবিড়। হাজারও প্রতিকূলতা সামলে বিগত দুই দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, সেটাকে ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির উঠে দাঁড়ানো’র সঙ্গে তুলনা টেনে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তিনি। খবর ওয়েবসাইটের। দিল্লীর প্রথম সারির দৈনিক দ্য হিন্দুস্তান টাইমসে ২৪ অক্টোবর একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখে তার এই মতামত জানান স্যার মার্ক। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে অর্থনীতির ধারা কোথায় আর কীভাবে ভিন্ন খাতে বইছে, সেখানে তার নিজস্ব ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি। বিবিসির হয়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ কভার করার সুবাদে মার্ক টালি বাংলাদেশের ঘরে ঘরে একটি সুপরিচিত নাম। তিনি লিখেছেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একাত্তরে যেভাবে সেখানে গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল, অর্ধশতাব্দী পর সেই ভস্ম থেকে থেকে উঠে দাঁড়ানো কম কথা নয়।
যুদ্ধ কভার করতে গিয়ে ঢাকা থেকে রাজশাহী যাওয়ার পথে তিনি নিজের চোখে দেখেছিলেন সেই ধ্বংসলীলার ছবি, আর সেখান থেকে আজ বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানো তাকে তাই আরও বেশি মুগ্ধ করে। স্বাধীনতা অর্জনের পর মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। তারপর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দেয়, সেনা কর্মকর্তারা জড়িয়ে পড়েন ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে। সেই পর্বেই তদানীন্তন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তুলনা করেছিলেন তলাবিহীন ঝুড়ি’র সঙ্গে। সেই প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেই মার্ক টালি লিখেছেন, তার পরেও কিন্তু গত ২০ বছর ধরে বাংলাদেশে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে নিয়মিত হারে এবং বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশ মডেলকে উন্নয়নের একটি প্রতিষ্ঠিত ধারা হিসেবে মেনে নিচ্ছেন। বাংলাদেশ যে তার আজকের জায়গায় এসে পৌঁছেছে, এর পেছনে প্রধানত দুটো ফ্যাক্টর কাজ করেছে বলে মার্ক টালির অভিমত। আর এই দুটো জায়গাতেই তারা ভারতের চেয়ে ভিন্ন পথে হেঁটেছে। প্রথমত, দুর্বল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ একটা সময় কার্যত বাধ্য হয়েছে দাতা দেশ ও উন্নয়ন সহযোগীদের পরামর্শ মেনে নিতে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যদিও একটা তীব্র সমাজতান্ত্রিক ধারা ছিল এবং বেসরকারীকরণকে জনবিরোধী বলে ভাবা হতো তারপরেও রাজনীতি দূরে সরিয়ে রেখে সে দেশের সব সরকারই আন্তর্জাতিক দাতাদের উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিয়েছে। অথচ প্রতিবেশী ভারতে কিন্তু বেসরকারীকরণ নিয়ে সব সময়ই একটা দ্বিধা কাজ করেছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের উন্নয়নে এনজিও বা বেসরকারী সংস্থাগুলোকে সব সময়ই একটা বড় ভূমিকা পালনে উৎসাহ দেয়া হয়েছে, যেটা ভারতে কখনই হয়নি। যেমন, দ্য ইকোনমিস্টের মতে, বাংলাদেশের ব্র্যাক এখন বিশ্বের বৃহত্তম স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা এনজিও। তাদের কর্মসূচী বাংলাদেশকে চরম দারিদ্র্য থেকে উত্তরণে সাহায্য করেছে এবং বিশ্বের অন্তত ৪৫টি দেশের এনজিওগুলো এখন ব্র্যাকের সেই পথ অনুসরণ করছে।
মার্ক টালি আরও লিখেছেন, এই অর্থনৈতিক উন্নয়নই কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সেই রাজনৈতিক পুঁজিটা দিয়েছে, যার জোরে তিনি ভারতের কাছে দেশটা বেচে দেয়া হচ্ছে এই সমালোচনা অগ্রাহ্য করতে পেরেছেন এবং পেরেছেন মনমোহন সিং ও নরেন্দ্র মোদি, পরপর ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে। এই সুসম্পর্কের সুবাদেই স্থল সীমান্ত চুক্তির মতো বহু বছরের অমীমাংসিত ইস্যুও নিষ্পত্তি হতে পেরেছে। মার্ক টালির মায়ের জন্মস্থান ছিল আখাউড়ায়। সেই আখাউড়া থেকে আগরতলা পর্যন্ত রেলপথ স্থাপনের কাজ চলছে জোর কদমে। তা সম্পূর্ণ হলে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের বাণিজ্য ও সংযোগ আলাদা মাত্রা পাবে বলেও তিনি ওই নিবন্ধে মন্তব্য করেছেন। তবে পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক প্রচারণা এবং বাংলাদেশের জন্য অমর্যাদাসূচক নাগরিকত্ব আইনের বাস্তবায়ন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলেও তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন। বাংলাদেশের জিডিপি বা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্যিই ভারতকে টপকে যাচ্ছে কিনা, তা নিয়ে এ দেশে বিতর্ক চলছে গত বেশ কিছু দিন ধরেই। নামি ভারতীয় অর্থনীতিবিদরা অনেকেই মন্তব্য করেছেন, আইএমএফ যে মাপকাঠিতে এই পূর্বাভাস করেছে সেটা ঠিক নয়। বরং অন্য উপযুক্ত মাপকাঠিতে ভারতই নাকি অনেক এগিয়ে আছে! প্রবীণ বিশ্লেষক ও ভাষ্যকার মার্ক টালি কিন্তু পরিষ্কার ভাষায় তার মত জানিয়ে দিয়েছেন-‘বাংলাদেশ যেভাবে ধ্বংসের ছাই থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে, পারলে ভারতের সেটা থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত।’