1. admin@ddnnewsbd.com : admin : ddn newsbd
  2. mamahbubulalom@gmail.com : mahbubul alom : mahbubul alom
মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫, ০২:৫১ অপরাহ্ন

পাবনা সদরের ১৮ ও ১৯ শতকের স্থাপত্য ও শৈলী-মুশ্শারাত তাসনিম মৃদুলা

প্রতিবেদকের নাম :
  • আপডেটের সময় : মঙ্গলবার, ১ এপ্রিল, ২০২৫
  • ১৬০ সময় দর্শন

(পাবনা সদরের ১৮ ও ১৯ শতকের স্থাপত্য ও শৈলী সম্পর্কে সম্প্রতি একটি গবেষণা কর্ম প্রস্তুত করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা ইতিহাস বিভাগের ২০২২-২০২৩ শিক্ষা বর্ষের ছাত্রী মুশশারাত তাসনিম মৃদুলা। এটা তার একান্তই নিজস্ব গবেষণা। )

***   বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে রাজশাহী বিভাগের দক্ষিণ পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত পাবনা একটি প্রাচীন ও সমৃদ্ধ জনপদ। পাবনা জেলা প্রতিষ্ঠিত হয় (১৮২৮ খ্রি:) উনিশ মতকের গোড়ার দিকে,কিন্তু বহু পূর্ব থেকেই এ ভূ-ভাগ প্রাচীন জনপদ হিসেবে পরিচিত। পূর্ব ভারতে গড়ে ওঠা পুন্ড্রবর্ধন ভুক্তির অংশবিশেষ পাবনা গৌড় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার এ অঞ্চলে গৌড় অধিকারের (১২০৪ খ্রি:)) মধ্য দিকে এ অঞ্চলে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। পর্যায়ক্রমে তুর্কি ,আফগান,মোগল ও ইউরোপীয়রা তাদের প্রয়োজনীয় বিভিন স্থাপত্য ইমারত নির্মাণ করে এবং এসব নির্দশনে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির কমবেশি প্রভাব রেখে যায়। অতএব পাবনায় ইমারত নির্মাণ ক্ষেত্রে তিনটি পর্যায় লক্ষণীয়- ক.সুলতানি যুগ (১৩ শতক-১৬ শতক),খ.মুগল যুগ(১৬ শতক-১৮ শতক) ও গ. ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল (১৭৫৭-১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ) ১
সুতরাং, ১৮ ও ১৯ শতকের স্থাপত্যসমূহ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনাসলের ইমারত সমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে, যা মিশ্ররীতির শৈলী ((Campsite style) বা ইন্দো ইউরোপীয় বা ইন্দো-ব্রিটিশ স্থাপত্য নামে পরিচিত।২ ইউরোপীয় স্থাপত্যের সাধারণ চরিত্র বিশেষ ভাবে প্রতিফলিত হলেও এতে দেশীয় উপকরণের বিষয়টি একেবারে চাপা পড়েনি।

ইতিহাস : ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮২৮ সালে পাবনা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ১৩ শতকে সুলতানি আমলে এখানে শাসকদের আধিপত্য বিস্তার হতে থাকে। ব্রিটিশ আমলে কোম্পানির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসায় মুনাফা ও ভূমি রাজস্ব সংগ্রহ করা। জমিদারদের সাথে একসময় ব্রিটিশ শাসকদের এই লেনদেন শুরু হয়।জমিদাররা তাদের জমিদারির এলাকাভেদে একাধিক বাসস্থান ও প্রশাসনিক ভবন,মসজিদ,মন্দিও নির্মাণ করেন।

পাবনা জেলায় সাঁতৈল জমিদার,তাড়াশের রায় বংশ,জমিদার অন্নগোবিন্দ চৌধুরী,তাঁতিবন্দের জমিদার বংশ,জমিদার লোকনাথ মৈত্র,দুলাই চৌধুরী,গোবিন্দ চৌধুরী প্রমুখ জমিদারদের বসবাস ছিল। জমিদারদের মধ্যে তাড়াশের রায় বংশ অন্যতম প্রভাবশালী ছিল। এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা মুর্শিদাবাদের নবাব বাসুদেব তালুকদার রায় চৌধুরী ছৌধুরী উপাধি গ্রহন করেন। পরবর্তীতে রামসুন্দর,বনওয়ারী লাল(রায় বাহাদুর)বনমালী রায় বাহাদুর জমিদারির দায়িত্ব পালন করেন।৩

আঠার শতকের শেষ ভাগে নওয়াবি শাসনের ক্রমাবনতি ঘটলে নব্য জমিদার শেণির উদ্ভব হয়।৪ তারা নিজেদের প্রভাব ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য নানান স্থাপত্য নির্মাণ শুরু করেন। যা ঔপনিবেশিক শাসনে প্রভাব ফেলে,যার প্রতিফলন স্থাপত্যসমূহে দৃশ্যমান। তিন ধরনের স্থাপত্য নির্দশন দেখা যায়-
১. শাসকদের প্রয়োজনে নির্মিত স্থাপত্য
২. নীল কুঠি
৩. জমিদার বাড়ি ৫

পাবনা সদরটি সেসময়ের প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তাই জমিদাররা গুরুত্ব অনুসারে বসতবাড়ি,মসজিদ,মন্দিও,লাইব্রেরী নির্মাণ করেছিলেন এবং ব্রিটিশরা প্রয়োজনীয়তা অনুসারে প্রশাসনিক ভবন,স্কুল,কলেজ,নীলকুঠি,জেলখানা নির্মাণ করেন। এছাড়া উচ্চ মধ্যবিত্ত হিন্দু ব্যবসায়ীদের তৈরি অসংখ্য বসতবাড়ির অস্তিত্ব রয়েছে। যার অধিকাংশই সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসাবস্থায় রয়েছে।

পাবনা সদরের জমিদার বাড়িসমূহ :
স্থাপত্য রীতি : স্থাপত্যের গঠন ও অলংকরণে ইন্দো-ইউরোপীয় মুঘল৬,রোমান,গ্রীস৭ ও ভারতীয় প্রভাব দৃশ্যমান। বৃটিশ শাসকরা প্রশাসনিক কাজে কোলকাতায় অবস্থান করায়,সেখানে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় যেসকল ইমারত তৈরি হয়েছিল,সেগুলোর অনুকরণেই এখানকার জমিদাররা তাদের বসতবাড়ি নির্মাণ করেন। যেমন: ওয়ারেন হেস্টিং ইউরোপীয় শৈলীর প্রভাবকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, উদাহরণস্বরুপ-হেস্টিং ভবন।৮
আপরদিকে লর্ড কার্জন মোঘল স্থাপত্যের প্রষ্ঠপোষক ছিলেন,উদাহরণস্বরুপ-ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।

স্তম্ভ ও পিলার : স্থাপত্যের স্তম্ভ ও পিলার নির্মাণে উভয় ক্ষেত্রেই গ্রীক এবং রোমান রীতির কলাম দেখা যায়,শৈলীগুলো সাধারণত: ক.কোরিন্থিয়ান,খ.সার্পেটাইন ফ্লুটেড কলাম (ঝবৎঢ়বহঃরহব ভষঁঃবফ পড়ষঁসহ),গ.ব্রিকড রীতিতে, ঘ.মুঘল রীতির অনুরুপ স্টাকো অলংকারকরণযুক্ত।, ঙ.ডোরিক
স্তম্ভ ও পিলারকে মাঝের আর্চে “ কি স্টোন’’যুক্ত থাকে। জমিদার বাড়ির প্রবেশ পথ,সম্মুখ বারান্দা.জানালা,দরজার চারপাশে ফ্রেমের মত করে এ সকল স্তম্ভ ও পিলার নির্মিত হয়েছে। এমনকি প্রায়শই অলংকরণের স্বার্থে স্থাপত্যের কর্ণারে বা প্রবেশ পথে জোড়া স্তম্ভ পরিলক্ষিত হয়। যেমন,শিতলাই হাউজ এর দোতলার কর্ণার এবং তাড়াশ জমিদার বাড়ির প্রধান ফটক। প্রায়শই স্তম্ভ গুলো অর্ধেক বা অসম্পূর্ণরুপে নির্মিত,যেন তা পাশ^বর্তী দেয়ালের সাথে মিশে গেছে।এছাড়াও ভিতের অংশে ‘রোসেটা’নতশা অনেক বেশি ব্যবহৃত হয়েছে,যা স্থাপত্যের চারপাশে ভিতের অংশে অলংকরণের জন্যেও রোসেটার’ ব্যবহার দেখা যায়।

শেড :
বসতবাড়িগুলোর দরজা,জানালা এবং বারান্দার উপরের অংশে ‘ল্যুভর শাটারড, (খড়াঁৎব ংযঁঃঃবৎবফ ) শেড যুক্ত। যা কাঠের তৈরি। তবে অলংকরণের ক্ষেত্রে লোহার তৈরি অলংকৃত শেড ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন : শিতলাই হাউজের জানালার শেড।

ক্স রেলিং :
সিড়িতে এবং বারান্দায় রেলিং এর ব্যবহার হয়েছে। যেগুলো উচ্চ মানের অংলকরণে সমৃদ্ধ। অলংকরণে ব্রিটিশ ও মুঘোল ‘ইন্ট্রিকেট’ নকশা লক্ষণীয়।
ক্স সিড়িতে কাঠের এবং লোহার অলংকরণ যুক্ত রেলিং থাকতো। লোহার রেলিং গুলো ছাঁচে ঢেলে নির্মিত হয়েছে। এই ধরণের রেলিং দাপ্তরিক ভবন গুলোতেও ব্যবহার হয়েছে। যেমন : জজ কোর্ট।
বারান্দায় প্লাস্টার দ্বারা নির্মিত ‘ইন্ট্রিকেট’(ওহঃৎরপধঃব)রীতিতে রেলিং দেয়া হতো। যেমন: তাড়াশ জমিদার বাড়ি।
ক্স স্থাপত্যরীতি : ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের বিশেষ গুণাবলী হল: লম্বা সিড়িযুক্ত উঁচু ভিত,ইটালীয় রেনেসা প্রকৃতির খোলা প্রবেশ পথ ও বারান্দা,গ্রেকো রোমান পেডিমেন্ট ১০ ,উলম্ব দরজা ও জানালা,অভ্যন্তরে কাঠের ব্যালাস্ট্রেট সিড়ি,মোঘল স্থাপত্যের মতো ছত্রী,বাল্ব গম্বুজ,কৌণিক খিলান,ব্রাকেট,পলেস্টারার নির্মিত জালি নকশা অন্যতম মিশরীয় ঢালু প্রাচীর।
ক্স কোলকাতা ক্লাসিক শৈলীর মধ্যে,অর্ধ স্তম্বের উপর নির্মিত পেডিমেন্ট,দ্বিতল থেকে নি¤œতলের পৃথকীকরণ দ্বিপত্র বিশিষ্ট উলম্ব জানালা দরজা এবং জানালার উর্ধাংশে কী-স্টোন বিশিষ্ট অর্ধাকৃতি ফ্যান-লাইট ব্যবহার হয়েছে। ১২
ক্স স্থাপত্যের ছাঁদের অংশে ‘বুরুজ’যুক্ত থাকে।
ক্স স্থাপত্যের কার্ণিশের ফ্রিজের অংশে সাধারণত অলংকরণন যুক্ত থাকে। যাকে ব্রাকেট বা ফরবেল বলে। এছাড়াও ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়, যেগুলোর চারপাশে স্টাকো অলংকরণ যুক্ত। স্থাপত্যগুলো লাল ইট,কংকর,চুনা পাথর,লোহার ফ্রেম দ্বারা নির্মিত।১৩
ক্স স্থাপত্যের অভ্যন্তরে কুলুঙ্গি যুক্ত,যা প্রদীপ,মূর্তি বা ধর্মীয় গ্রন্থ রাখার কাজে ব্যবহৃত হতো।
ক্স ভবনের ছাঁদ গুলো লোহার বিম ও বর্গার উপর ঢালি দ্বারা নির্মিত।

পাবনা সদরের জমিদার বাড়ির উদাহরণ :
পাবনা সদরের প্রাণকেন্দ্রে (ঢাকা রোডে)বনমালী রায় বাহাদুরের তাড়াশ ভবনটি অবস্থিত। ১৮ শতকে ইন্দো-ইউরোপীয় রীতিতে ভবনটি নির্মিত হয়। পূর্বমুখী দ্বিতল ভবনটি ১.৫৯৭৫ একর ভূমির উপর নির্মিত। যার চারটি রোমান কোরিন্থিয়ান স্তম্ভেও উপর আকর্ষণীয় দ্বিতল গাড়ি বারান্দা প্রাচীন কীর্তির স্বাক্ষর বহন করে। প্রাসাদের সম্মুখের উন্মুক্ত প্রাঙ্গনের শেষ প্রান্তে প্রধান প্রবেশ ফটকটি অবস্থিত। ফটকটির দুপাশের্^ দুটি চারটি স্তম্ভ এবং নরমান থামের শিরাবরকের মাঝখানে বিশাল আকৃতির অর্ধ বৃত্তাকার খিলান রয়েছে। এই প্রবেশ পথ হতে মূল ভবনটি ৩৫ মিটার পশ্চিমে অবস্থিত।
দ্বিতল বিশিষ্ট তাড়াশ ভবনের বাহিরের পরিমান উত্তর-দক্ষিণ ৩০ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৬ মিটার । ভবনটি ৫১ সে:মি: প্রশ¯ ইটের দেয়াল দ্বারা নির্মিত। অপরুপ কারুকাজ সমৃদ্ধ এই জমিদার বাড়িটির নিচতলায় ৮টি কক্ষ এবং ২য় তলায় ৮টি কক্ষ বিদ্যমান। এর মধ্যে নিচতলায় কেন্দ্রীয় ভবনটির ছাদে পিতলের পাতে বিশেষ ভাবে জ্যামিতিক বর্গ ও ফুলের নকশা অত্যন্ত আকর্ষণীয়।ভবনটির ছাদ লোহার বিম ও বর্গার উপর টালির দ্বারা নির্মিত। প্রাচীন এই ভবনটির দিকে মোট ৮০টি দরজা রয়েছে। যেগুলো দুই স্তর বিশিষ্ট -১টি কাঠের এবং অপরটি কাঁচের তৈরি। ভবনটিতে ৫৩টি জানালা রয়েছে। যে গুলোতে ‘খড়খড়ি বা খড়াবৎ’ব্যবহার করা হয়েছে। গাড়ি বারান্দায় ব্যবহৃত গোরাকার স্তম্ভ সমূহতে সাসানিক থামের পাদপট্র ব্যবহার করা হয়েছে এবং অন্যান্য পিলারগুলো নরমান থামের শিরাবরকে সজ্জিত।
নিচতলা হতে উপরে ওঠার জন্য ভবনের উত্তর দিকে একটি কাঠের সিড়ি রয়েছে। তাড়াশ ভনের প্রতœতাত্তিক গুরুত্ব বিবেচনা করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ৮ জানুয়ারি ১৯৯৮ সালে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। বর্তমানে তাড়াশ ভবন প্রতœতত্ত অধিদপ্তর, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত। ১৪

গাঠনিক অলংকরণ : ভবনের ভীত এবং গাড়ি বারান্দার স্তম্ভের (ঈড়ষঁসহ) রোসেটা অলংকরণ যুক্ত।এছাড়াও কিসোটানের উপর,দোতলার বারান্দার রেলিং এ এই নকশা লক্ষাণীয়।
ক্স ভবনের ভিতরের নিচতলার কক্ষের দেয়ালে নিচের অংশে কাঠ দ্বারা বেষ্টিত। যেগুলো উপরে নিচে সারিবদ্ধ ভাবে চারকোণা নকশা যুক্ত। কক্ষের অভ্যন্তরিণ দরজার উর্ধাংশে ফ্রেমের কওে মুঘলীয় ফুল লতার বর্ডার যুক্ত। যা পলেস্তারার উপর হালকা ভাবে অগভীর দাগ কেটে তার উপর রঙ তুলি দ্বারা অলংকৃত।
ক্স নিচতলা থেকে দোতলায় ওঠার সিড়িতে অলংকৃত লোহার রেলিং যুক্ত এবং দোতলা থেকে ছাদের সিড়িতে অলংকৃত কাঠের রেলিং ব্যবহার করা হয়েছে।
ক্স ভবনের দরজার কাঠের সাথে জ্যামিতিক নকশা যুক্ত রঙিন কাঁচের ব্যবহার লক্ষণীয়। যা কক্ষগুলোর আরও শোভা বর্দ্ধন করেছে। দরজার পাল্লায় ‘ল্যুভর শাটার যুক্ত’(খড়াঁৎব ংযঁঃঃবৎবফ ),এবং ৬টি জানালার উপরের অর্ধবৃত্তাকার অংশেও যুক্ত। যা আলো বাতাস চলাচলে সহায়তা করে।
ক্স নিচ তলার মেঝে পলেস্তারায় নির্মিত এবং দোতলার মেঝে সূক্ষ লাল মোজাইক যুক্ত। মোজাইকের উপর হালকা নকশার দেখা মেলে।
দোতলার বারান্দার উপরের অংশে ‘ইন্ট্রিকেট জালি’প্যাটার্নের শেড যুক্ত।
ক্স ভবনের অভ্যন্তরে প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা রয়েছে।
ক্স ভবনের চার পাশে ছাদের কার্নিশের নিচে ফিজের সাথে অলংকরণ যুক্ত সারিবদ্ধ করবেল/ব্রাকেট রয়েছে। যাকে ‘ডেন্টিল ট্রিম’ (উবহঃরষ ঃৎরস) সাথে বা ‘ডগটুথ’ (উড়মঃড়ড়ঃয) ১৬ বলা হয়।
ক্স ভবনের অভ্যন্তরে পিলারগুলো জেরিক রীতিতে নির্মিত।

প্রধান ফটক :
তাড়াশ জমিদার বাড়ির প্রধান ফটকটি বর্ধমানে বিট্রিশ আমলে তৈরি কার্জন গেটের অনুরুপ। গেটের ঊর্ধাংশে দুপাশে,সামনে পেছনে দুজোড়া ‘রোসেটা’ স্ট্রাকো রয়েছে এবং কার্নিশ ও ফিজের অংশে সারিবদ্ধ ‘ব্রিকড ডেন্টিল’১৮ ব্রাকেট বা করবেল দ্বারা সজ্জিত।

শীতলাই হাউজ(শীতলাই জমিদার বাড়ি) :
১৯০০ সনে২৪ নির্মিত পাবনা শহরের রাঘবপুরে শীতলাই হাউজ অবস্থিত। এই দ্বিতল ভবনটির পূর্বদিকে সম্মুখ প্রাসাদ। ভবনের কেন্দ্রকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এটিকে দক্ষিণ ও উত্তরদিকে প্রসারিত করা হয়েছে।১৯ ভবনের পবেশ পথের উপর ত্রিকোণাকার পেডিমেন্ট যুক্ত। এছাড়াও ভবনের প্রতি পার্শের শীর্ষে এরকম পেডিমেন্ট যুক্ত। প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় অর্ধ বৃত্তাকার খিলানের সারি রয়েছে। যেগুলো কিস্টোন যুক্ত। প্রসাদের কেন্দ্র ক্রমশ উচুঁ হয়ে সবশেষে পাখির নকশা ধারণ করেছে। ছাদে বেষ্টনীর প্যারাপেটে গোল ছিদ্র ও ছোট ছোট বুরুজ স্থাপন করা হয়েছে। এ ভবনের উত্তর পশ্চিম কোণে একটি মাত্র গম্বুজ রয়েছে এবং ছোট কলম আকারের শীর্ষ বুরুজের ব্যবহার এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। অষ্টভুজাকৃতির গম্বুজটির নির্মাণে মোঘল স্থাপত্যের সঙ্গে ইউরোপীয় স্থাপত্যেরীতির সুসামঞ্জস্য লক্ষণীয়।২১ শীতলাই ভবনের পূর্ব পাশটি কোরিস্থিয় কলামে সজ্জিত বিশাল গম্বুজের একেকটি শিরে একটি করে সাপের ফণার নকশা রয়েছে। ২১
অর্ধবৃত্তাকার খিলানে সৃষ্ট ভবনের কেন্দ্রস্থলে বারান্দা বা প্রবেশ পথের দুই ধারে নির্মিত হয়েছে টানা বারান্দা। এ ভবনে ত্রিশটি কক্ষ এবং মেঝে মার্বেল পাথরে নির্মিত।২২
শীতলাই ভবনটি ইউরোপীয় রেনেসাঁ নীতিতে এবং ব্রিটিশ বাংলার ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের অন্তভুক্ত। এই ভবনের স্থাপত্যরীতি ও গঠনশৈলীতে ঢাকার কার্জন হলের সাদৃশ প্রত্যক্ষ করা যায়।২৩ এমনকি উত্তর দিকের প্রবেশ পথের দোতলার অংশে দুপাশে টানা বারান্দা রয়েছে। দোতলায় নির্মিত অর্ধবৃত্তাকার খিলান গুলো জানালার সাথে ফ্রেম আকারে গঠিত কিন্তু নিচ তলার খিলানযুক্ত নকশা গুলো ফাঁকা দেয়ালের উপর সারিবদ্ধ ভাবে গঠিত। উত্তর দিকের খিলানের মাঝে ডোরিক কলাম নির্মিত এবং পূর্ব দিকের খিলানের মাঝের খিলানের মাঝে সরু কোরিস্থিয়ান দেখা যায়।
ভবনের ভিতের অংশে চারকোনা বক্সের মতো নকশা ও রোসেটা নকশা দ্বারা অলংকৃত। ছাদের কার্নিশের তলদেশে ব্রাকেটের নকশায় একক বক্রাকার পাতার মোটিফের সারি রয়েছে। যা ‘ হাই রিলিফে’ নির্মিত। তার নিচে ফ্রিজের অংশে ‘ডেন্টিল ব্যান্ড’ (উবহঃরষ নধহফ) ২৫ করবেলের সারিযুক্ত।
গম্বুজের প্রতি কোণায় একজোড়া কোরিস্থিয়ান নির্মিত হয়েছে। শীর্ষে বুরুজের উপর ত্রিশুল অবস্থিত। ভনের দরজা-জানালা গুলো ‘ল্যুভর শাটার’যুক্ত এবং উপরের অংশে অর্ধবৃত্তাকারে ‘ফ্যানলাইট’ যুক্ত। আবার লোহার ফ্রেমের সাথে গøাস যুক্ত জানালার ব্যবহারও হয়েছে।বারান্দা,জানালার শেড নির্মাণে কাঠের ল্যুভর শাটার এবং লোহার তৈরি লম্বা ও সম্মুখভাগ ধারালো অলংকরণ বিশিষ্ট শেড তৈরি করা হয়েছে। ভবনের প্রধান প্রবেশ পথের দরজার নকশায় ইসলামিক মোটিফ পরিলক্ষিত হয়। তিনটি অর্ধবৃত্তাকার খিলানের মাঝে তিনটি কাঠের দরজা নির্মিত। যেগুলো ‘উত্তল’ নকশা যুক্ত। দরজার উপরের অর্ধবৃত্তাকার অংশে ফ্যানালাইটে লোহার তৈরি লতানো ইসলামিক বা মুঘল মোটিফ যুক্ত। দরজার উপর খিলানের অংশে ফুলেল নকশা যুক্ত।(রিলিফ)। দরজার দুপাশে পিলারে লতানো মোটিফে স্টাকো নকশা যুক্ত।

চাকী জমিদার বাড়ি :
পাবনা শহরের জেলা জর্জ কোর্টের পাশে অবস্থিত এবং সুচিত্রা সেনের পৈত্রিক বাড়ি সংলগ্ন। এটির মালিক ছিলেন রাম গোপাল চাকী। এই জমিদারদের বলা হতো লেঠেল জমিদার। ১৯০০ সালে এই বাড়িতে গৃহ প্রবেশ হলেও ১৯৫০ সালে বাড়িটি ছেড়ে কোলকাতা চলে যায়। বর্তমানে এটি ফাঁকা ও জরাজীর্ণ।৪২
বাড়িটির গঠনে ইসলামিক বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান। এর সম্মুখ ভাগের কেন্দ্রীয় অংশটি অর্ধগোলাকৃতির বারান্দা গঠন করেছে এবং প্রবেশ পথের সৃষ্টি করেছে। গোলাকার বারান্দার শীর্ষে ছাদের অংশে ত্রিকোণার ক্ষুদ্র পেডিমেন্ট নির্মিত। ছাদেও কার্নিশে ‘ডেন্টিল ট্রিম’ ব্রাকেট যুক্ত। বৃত্তাকার প্রবেশ পথের দুপাশে দোতলা ও নিচ সতলায় টানা বারান্দা রয়েছে। যেগুলোতে দুপাশে দুজোড়া করে মোট আটটি খিলান রয়েছে। দুপাশে শেষ প্রান্তে দুটি করে মোট চারটি উলম্ব জানালা রয়েছ্ েগৃহে প্রবেশের অভ্যন্তরীণ দরজান গুলিও খিলান যুক্ত।

স্তম্ভ গুলো পুরোপুরি ইসলামিক রীতি অনুসরণ করেছে। অর্ধবৃত্তাকার অংশের দোতলার স্তম্ভ গুলো রসুন আকৃতির ভিত থেকে উপরে উঠে শীর্ষে চারকোণ সৃষ্টি করেছে। নিচ তলার স্তম্ভের উপরের অংশ বালতির আকৃতির ন্যায় এবং প্রতিটি কলাম গোলাকৃতির। ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান এর ‘মুসলিম স্থাপত্য’ বইটিতে খিলান ও স্তম্ভের রেখা চিত্র গুলোর সাথে এই ভবনের খিলান ও স্তম্ভের নকশার সাদৃশ্যতা রয়েছে। ভবনের দোতলার অংশে খিলানের আকার ‘গন্থিক খিলান’৪৩ এর অনুরুপ।
স্থাপত্যের দুপাশে উলম্ব আকৃতির বড় বড় জানালা রয়েছে। যে গুলো ল্যুভর শাটার জানালা বিশিষ্ট এবং জানালা দরজার অর্ধবৃত্তাকার অংশে ‘ভূসুয়ার্স খিলানের’৪৪ নকশার মতো ইটের বিন্যাস রয়েছে। ছাদের রেলিং এ ছোট ছোট চারকোণা স্তম্ভের চারকোণা খোপের মাঝে রোসেটার মতো স্ট্যাকো যুক্ত এবং রেলিং এ কর্ণারের ক্ষুদ্র পিলার গুলোর উপর ফুটোন্ত পদ্মর মুখ যুক্ত কলস বসানো রয়েছে।

পাবনার মসজিদের স্থাপত্য :
ভাড়ারা মসজিদ – পাবনা সদর থানার অন্তর্গত পাবনা থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে ভাড়ারা গ্রামে মসজিদটি অবস্থিত। এটি আয়তাকৃতির দৈর্ঘ ১৩.৫১ মিটার এবং প্রস্থ ৬.১০ মিটার। দেয়াল ০.৯১ মিটার চওড়া এবং গম্বুজের ব্যসার্ধ ৬.১০ মিটার।২৬
এই মসজিদটি কুড়িগ্রামে মুঘল আমলে নির্মিত চান্দামারি মসজিদের অনুরুপ। ভাড়ারা মসজিদের চার কোণে চারটি অষ্টকোণাকৃতি পার্শ¦বুরুজ রয়েছে। যা ক্রমশ ছাদে উঠে গেছে এবং বুরুজ শীর্ষে ছোট ‘ কিউপোলা’ যুক্ত এবং কিউপোলার নিচে মারলিন নকশা যুক্ত।২৭ এটি চান্দামারি মসজিদেরই অনুরুপ। মসজিদের চারপাশের পিলারে ভিতটি কলম আকৃতি। যেখান থেকেই পাশর্^ বুরুজ উথ্থিত হয়েছে। গম্বুজের অভ্যন্তরে ড্রামের চারদিকে ঘিরে রয়েছে ‘মারলন’ নকশা।২৮

১৭৫৭ সালে বাদশাহ শাহ আলমের রাজত্বকালে দৌলত খা এর পুত্র আসালত খা এই মসজিদটি নির্মাণ করেন।২৯ মসজিদের সম্মুখে পৃথকভাবে নির্মিত দোচালা প্রবেশ ফটক রয়েছে। যা কুড়ে ঘরের দোচালা ছাদের আদলে তৈরি। গম্বুজগুলো ‘ট্রান্সভারস’ খিলান দ্বারা সমর্থিত।৩০ গম্বুজগুলোর ড্রামের উপর ফিনিয়াল যুক্ত। মাঝের গম্বুজের শীর্ষদেশ ফুটন্ত পদ্মপাপড়ির মতো সজ্জিত। দুপাশের গম্বুজের শীর্ষে কলসের আকৃতির বুরুজ যুক্ত। ছাদের প্যারাপেটের অংশে ও কার্নিশের তলদেশে দৃষ্টিনন্দন ‘মারলন’ নকশা যুক্ত।

মসজিদের কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের শীর্ষে কালো ব্যাসল্ট পাথরের শিলালিপি রয়েছে। যেখানে মসজিদটির নির্মাণকাল, নির্মাণকারী ও সেসময়ে শাসকের নাম উল্লেখ রয়েছে।

মসজিদের অভ্যন্তরে তিনটি মিহরাব রয়েছে। মাঝের মেহরাবটি বাহিরে দেয়ালের দুপ্রান্তের শীর্ষে ব্যারেল আকৃতির বুরুজ রয়েছে। যার শীর্ষে চাঁদ-তারা যুক্ত। মিহরাবের দুপাশে কুলুঙ্গি যুক্ত। মাঝের মিহরাবটি ফুলেল লতানো নকশার মোটিফ যুক্ত। মিহরাব তিনটির শীর্ষ ভাগের অবতল অংশ এবং মসজিদেও ‘ট্রান্সভার্স খিলান’ গুলোর অবতল অংশে ‘মুকারনাস্’ নকশা দেখা যায়।
উত্তর পূর্ব দিকে একটি মিনার রয়েছে। মিনারের চারপাশে কলসি যুক্ত ক্ষুদ্রাকার চারটি স্তম্ভ রয়েছে। মিনারের কার্নিশের নিচে ‘ ডেন্টিল ট্রিম’ করবেল যুক্ত এবং ফ্রিজের অংশে লতানো অলংকরণ যুক্ত। মসজিদের দুই একটি কোরিন্থিনিয় রীতির স্তম্ভ রয়েছে।

কাচারি মসজিদ :
পাবনা সদরে কাচারি পাড়াতে অবস্থিত মসজিদটি কোনো নির্দিষ্ট রীতি অনুসরণে নির্মিত হয়নি। মসজিদটিতে মোট ২৬টি ছোট বড় মাঝারি ধরণের গম্বুজ রয়েছে। বড় চারটি গম্বুজ মিহরাব বরাবর অবস্থিত,মাঝারি আকৃতির চারটি গম্বুজ চারকোণায় অবস্থিত এবং ছোট আঠারটি গম্বুজ ছাদের সাথে সংলগ্ন পাশ^বুরুজের উপরে স্থাপিত।৩১

এই মসজিদের দুটি শিলালিপি আছে। একটি শিলালিপি থেকে মসজিদের নির্মাণ সময় ১২৯৬ বঙ্গাব্দ এবং অন্যটিতে ১৩০০ বঙ্গাব্দ বলে জানা যায়।৩২ মসজিদটির দেয়াল ‘ব্রিকড প্যাটার্নযুক্ত’ বাহ্যিক স্তম্ভ গুলোতে কোরিন্থিয়ান রীতি পরিলক্ষিত হয়। মসজিদের ছাদের উপর অলংকৃত ক্ষুদ্রাকৃতির কলামের সারি দ্বারা সজ্জিত। কলামের উপর ‘শিখর’ যুক্ত। কলামের পাদদেশে ‘রসুনের’ মতো আকৃতি গঠিত। মসজিদের দেয়ালে ‘কুইন’ (ছঁড়রহং) অলংকরণ বৈশিষ্ট রয়েছে। স্থাপত্যের চারপাশে দেয়ালের উপরিভাগে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা রয়েছে। যেগুলোর চারপাশে ‘রোপ’ এবং ‘ফ্লোরোল’ স্টাকো রয়েছে। জানাগেুলো খিলান যুক্ত। খিলানে ফ্লোরাল লতানো নকশা রয়েছে এবং জানালা ফ্যানলাইটে লোহার দ্বারা লতানো নকশা করা হয়েছে।
গম্বুজের গাত্রে টাইল মোজাইক করা। গম্বুজ গুলো উচুঁ শিখর যুক্ত। ছাদের কার্নিশে ঘন ‘ডেন্টিল ট্রিম’ করবেল দ্বারা অলংকৃত। ছাদের উপরের গম্বুজে নি¤œার্ধে খিলান দ্বারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুলুঙ্গি রয়েছে,যেগুলোর অভ্যন্তরে ফলের স্টাকো এবং খিলানের উপর লতানো বর্ডারের স্টাকো তৈরি হয়েছে। মসজিদের মিনার সাততলা বিশিষ্ট এবং ‘ইন্ট্রিকেট জালিকার’ ভেন্টিলেশন যুক্ত। প্রতি দুই তলায় বারান্দার মতো গোলাকার জালিকা রেলিং রয়েছে।
মসজিদের অভ্যন্তরে মুঘল রীতিতে কলাম নির্মিত এবং উপরে সিলিং এ ফ্যানের চারপাশে গোলাকার বর্ডার করা নকশা দেখা যায়। মিহরাবের সামনে স্তম্ভ যুক্ত খিলানের সারি মুঘল রীতির প্রতিফলন। মিহরাবের দুপাশে মিহরাবের আকৃতির বৃহদাকার কুলুঙ্গি আছে। মসজিদের বৈশিষ্ট গুলো মুঘল আমলের খাজা আম্বার মসজিদের সাদৃশ্যতা লক্ষনীয়।

দিলালপুর চৌধুরী বাড়ি মসজিদ :
মসজিদটি পাবনা শহরে আব্দুল হামিদ রোডের উত্তর পাশে চৌধুরী বাড়ির নিজস্ব অঙ্গনে অবস্থিত। এটি একটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। এতে তিনটি প্রবেশ পথ ও মিহরাব রয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অপেক্ষাকৃত উচুঁ। মসজিদেও অভ্যন্তরীণ ভাগে আড়াআড়ি খিলানের উপর ‘পেন্ডেন্টিভ’৩৩ গম্বুজটি আবস্থিত। ছাদে গম্বুজের চারপাশে মুঘল রীতির রেলিং যুক্ত। রেলিংয়ের মাঝে মাঝে কলসী ও শিখর যুক্ত ক্ষুদ্রাকৃতির স্তম্ভ রয়েছে। মসজিদ গাত্রে স্ট্যাকো অলংকরণ লক্ষ্য করা যায়। মিহরাবের দুপাশে কলসাকৃতির ভিত থেকে ছোট দুজোড়া কলাম উঠে এসেছে এবং শীর্ষে ত্রিকোণাকার নকশা তৈরি করেছে। মিহরাবের খিলান ও মসজিদের অভ্যন্তরীণ খিলানের অবতল অংশে ‘মুকারনাস’ রীতি যুক্ত। মিহরাব ও খিলানের উপর ফুল,লতা-পাতায় পলেস্টারার নকশা যুক্ত।
মসজিদটি উনবিংশ শতকের মাঝামাঝিতে আজিম উদ্দিন চৌধূরী অথবা তার পুত্র হায়দার জান চৌধুরী নির্মাণ করেছিলেন।৩৪ মসজিদের অভ্যন্তরীণ ‘ট্রান্সভার্স’ আর্চ ও দরজার খিলানের অবতল অংশে মুকারনাস নকশা রয়েছে। অভ্যন্তরীণ কলামগুলি জোড়া এবং কোরিন্থিয়ান রীতির।

পাবনা সদরের মসজিদের বৈশিষ্ট্য :
মসজিদ গুলোতে মুঘল স্থাপত্য রীতির প্রভাব লক্ষণীয় । যেমন – * একাধিক গম্বুজ যুক্ত, * সারিবদ্ধভাবে শিখর যুক্ত বুরুজের ব্যবহার, * মসজিদের অভ্যন্তরে খিলানের সারি, * কলাম নির্মাণের ক্ষেত্রে মুঘল ও ডোরিক রীতির পাশাপাশি কোরিন্থিয়ান রীতির ব্যবহার দেখা যায়, * ট্রান্সভার্স খিলান যুক্ত ডোমের নির্মাণ, * ছাদের অংশে ক্ষুদ্রাকার কলসের সারি নির্মিত হতো।

অলংকরণ :
খিলানের অবতলে ‘মুকারনাস’ নকশা দেখা যায়। ডোমের চারপাশে বা মসজিদের কার্নিশের প্রিজে সাধারণত ‘মারলন’ নকশা বা ফল,লতা-পাতার স্ট্যাকো দ্বারা অলংকৃত হয়েছে।
পাবনা সদরে নির্মিত মসজিদের তালিকা :
১. ভাড়ারা জামে মসজিদ
২. কাচারি জামে মসজিদ
৩. দিলালপুর চৌধুরী বাড়ি মসজিদ
৪. মৌলানা মুহাম্মদ আলী জামে মসজিদ
পাবনা সদরে নির্মিত জমিদার বাড়ির তালিকা :
তাড়াশ জমিদার ভবন
শীতলাই হাউজ
পয়দা জমিদার বাড়ি(জরাজীর্ণ ভগ্নাবস্থায়)
শাঁখারীপাড়া জমিদার বাড়ি(প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত)
মজুমদার জমিদার বাড়ি(ধ্বংসপ্রাপ্ত)
চাকি জমিদার বাড়ি

পাবনা সদরের মন্দিরের স্থাপত্য :
মন্দিরের তালিকা :
১. পাবনা জোড় বাংলা
২. জোতকলসা বাংলা মন্দির
৩. ভবানী সাহার মন্দির
৪. শ্রী রাধা গোবিন্দ মন্দির
৫. শ্রী জয়কালি মন্দির
৬. ভাঙ্গা কালি মন্দির
৭. শিঙে মহাশ্মশান কালি মন্দির
৮. রথঘর (আগের স্থাপত্যিক অস্তিত্ব নেই)

পাবনা জোড় বাংলা :
পাবনা সদরের দক্ষিণ রাঘরপুরস্থ শহরের পূর্ব দক্ষিণে জোড় বাংলা মন্দিরটি অবস্থিত। স্থানীয়দের মতে এটি মুর্শিদাবাদের নবাবের তহশীলদার ব্রজমোহন ক্রোড়ী আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন।৩৫ এটি দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরের অনুরুপ ভারী অলংকরণ দ্বারা গঠিত। মন্দিরটি লাল ইটে নির্মিত এবং টেরাকোটা যুক্ত। জোড়া কুড়ে ঘরের ন্যায় মন্দিরটি একটি উচুঁ ভিতের উপর নির্মিত। ৭.০১ মিটার উচুঁতে তৈরি মন্দিরটির দুটি কক্ষ রয়েছে। যার সামনের কক্ষের মোপ এবং পশ্চাতের কক্ষটি গর্ভগৃহ হিসেবে সব্যহৃত হতো।৩৬
মন্দিরের সামনে তিনটি খিলান যুক্ত দ্বার রয়েছে। গর্ভগৃহের উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে একটি করে এবং মোপ ও গর্ভগৃহের মধ্যস্থলে আরো একটি প্রবেশ পথ রয়েছে। মন্দিরের ছাদে দুটি দোচালা রয়েছে। দোচালার বহির্ভাগে বেশ বাঁকানো। মন্দিরটি আঠারো হাত পাশর্^ বিশিষ্ট এক খন্ড সম-চতুস্কোণ ভূমির উপর নির্মিত। এই বাংলা দালান দুটির উচ্চতায় ১৮হাত। ৪০
মন্দিরের সম্মুখ প্রবেশ দ্বারের খিলান তিনটি বেশ সূচালো এবং বহুভাজ যুক্ত। খিলানের স্তম্ভ গুলোর গাত্র বেশ মোটা এবং ইটের টালি ও টেরাকোটা দ্বারা সম্পূর্ণ রুপে আচ্ছাদিত। খিলানের অবতল অংশে ‘মুকারনাস’ অলংকরণ যুক্ত। যা ইসলামীর মোটিফকে চিহ্নিত করে। খিলানের উপরে ‘স্প্যানড্্িরলের’ দুপাশ ক্রমশ; দুদিকে ধনুকের মতো নেমে এসেছে। প্রবেশ পথের উপরে ছাদেও কার্নিশ ও ফ্রিজের অংশে চার সাড়িতে ভিন্ন মোটিফের অলংকৃত বর্ডার যুক্ত। খিলানের পিলারের উপরে চারপাশে চওড়া টেরাকোটার ঘন বর্ডার ব্যবহার করা যায়। যেগুলো ফুল,পাতা,জ্যামিতিক ও প্যাঁচালো জালিকাকার নকশা করা। মন্দিরের পেছনের বহি: গাত্রের দেয়াল গুলোতে ফাঁকা ফাঁকা ভাবে ‘রোসেটা’ স্ট্যাকো বসানো হয়েছে এবং ছাদের কার্নিশের অবতলে ‘করবেল’ দ্বারা সজ্জিত। সামনের ও পেছনের বহি:পিলার গুলোতে ইট গুলোকে উলম্ব আনুভূমিক বা তির্যক ভাবে বসিয়ে ভিন্ন রুপ প্রদান করা হয়েছে। গাথুনির মাঝে মাঝে সরু অলংকৃত টেরাকোটা দ্বারা এর শোভা বর্ধন করা হয়েছে। এছাড়াও স্থাপত্যের ভিতের অংশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুলুঙ্গির শ্রেনীবিন্যাস চোখে পড়ে।
মন্দিরের মপের মধ্যবর্তী অংশে এককখিলান যুক্ত প্রবেশ দ্বার রয়েছে,যার দুপাশে অষ্টকোণাকৃতির ছোট দুটি কলাম রয়েছে। কলাম দ্বয় থেকে স্প্যানড্রিলের অংশটি উপওে উঠে গেছে। যেখানে ইসলামিক অলংকরণ মোটিফে টেরাকোটা বসানো এবং আর্চের অংমে ‘মুকারনাস’ অলংকরণের গাত্র ঘেঁষে পৌরানিক দেব দেবীর মূর্তির পাশর্^ ফিগার যুক্ত টেরাকোটা দ্বারা সজ্জিত। অভ্যন্তরীণ গাত্রেও ইটের উপর ফাঁকা ফাঁকা ভাবে ‘রোসেটা’ স্ট্যাকো রয়েছে। এছাড়াও অভ্যন্তরীণ কক্ষ গুলোতে কুলুঙ্গির তৈরি করা হয়েছে।
প্রধান প্রবেশ পথের খিলানের উপরে টেরাকোটা নকশায় ঘন্টা গলায় হাতি অগ্রসরমান ,খিলানের স্প্যানডিলে নৃত্যরত নারী,পানপাত্র হাতে নারী,তীর ধনুক দিয়ে যুদ্ধ,মল্লযুদ্ধ,যুগল মূর্তি, ঢোল বাদক,গণেশ,পাল্কী যাত্রার দৃশ্য,উৎকীর্ণ করা হয়েছে। ছাদ কার্নিশের সাথে খোপ নকশার অনুভূমিক ও উলম্ব সারিতে প্রতিটি খোপে সামাজিক,পৌরানিক দৃশ্য,যুগ্ম মূর্তি উৎকীর্ণ। স্তম্ভের নিচের সারিতে খোপ গুলোতে হংসের সারি,মুক্তার মালাসহ হংস,ঢোল বাজনায় মত্ত বাদকবৃন্দ,রাজকীয় হাতি ঘোড়া দেখা যায়।৩৭
এছাড়াও হিন্দু দেব দেবীদের নানান ঘটনার টেরাকোটার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।

জোতকলসা মন্দির : পাবনা সদরে মালিগাছায় অবস্থিত। জোতকলসা মন্দিরটির গঠন জোড়বাংলার মতো। তবে একক কুড়ে ঘরের আকৃতি লাভ করেছে। এটি ১৮ শতকে নির্মিত।১৮ লাল ইটে তৈরি কাঠামোটির দেয়ালে নকশার তেমন চিহ্ন নেই। তবে দেয়ালে কিছু চারকোণা খোপের মতো আকৃতিতে অনুমান করা হয়,সেখানে টেরাকোটা বা নকশা করা ছিল। স্থাপত্যের ভিতরে কুলুঙ্গি নির্মিত রয়েছে।

শ্রী রাধা গোবিন্দ মন্দির : পাবনা সদরে শালগাড়িয়া মহল্লায় অবস্থিত। জমিদার রাজেন্দ্র নারায়ণ সাহা স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে ১২৬০বঙ্গাব্দে তার দত্তক পুত্র শ্রী রাধা গোবিন্দের নামে এ মন্দিরটি স্থাপন করেন।৩৯
মন্দিরটির গঠন ও অলংকরণে মুসলিম স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান। এর প্রবেশ পথের ফুল পাতার নকশা ভাড়ারা মসজিদের অনুরুপ। প্রধান ফটকের খিলানের স্প্যানন্ড্রিলের উপরের পেডিমেন্টটি ‘ব্রোকেন পেডিমেন্ট’ স্টাইলে গঠিত। পেডিমেন্টের কার্নিশের নিচে করবেল যুক্ত। খিলানের কেন্দ্রে ‘কিস্টোন’ রয়েছে। মন্দির প্রাঙ্গনে সেসময় নির্মিত তিনটি ভবন রয়েছে। সম্মুখ ভাগে ছাদযুক্ত বিশালাকার প্রার্থনার উঠান ও মন্দির রয়েছে। এর পিছন ভাগে পুরোহিতদের জন্য নির্মিত ঘর এবং তার পাশে শিখর বিশিষ্ট গম্বুজযুক্ত ছোটো ঠাকুর ঘর রয়েছে। পেছনের স্থাপত্যের খিলান ও খিলানে যুক্ত ‘ইন্টিকেট জালিকা’ মুঘল স্থাপত্যকে চিহ্নিত করে। প্রধান মন্দির স্থাপত্যের দুপাশে ১০টি স্তম্ভ রয়েছে। স্তম্ভের উপরে ফ্রিজের অংশে মুঘল রীতির ঝালর নকশা দ্বারা অলংকৃত মন্দিরের মধ্যবর্তী কলাম গুলোতে ব্রিটিশ প্রভাব জরিত। যেখানে কোরিন্থিয় কলামের বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান সিলিং এ ফ্যানের গোড়ায় এবং চারপাশে অলংকরণ করা,যা ‘কাচারি মসজিদের ’ন্যায় পরিলক্ষিত হয়।

ভাঙ্গা কালিবাড়ি মন্দির : পাবনা সদরের শালগাড়িয়ায় ১১৫৩ বঙ্গাব্দে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়।৪১ মন্দিরটি এক সময় ভগ্ন অবস্থায় পতিত হলে তা ভাঙ্গা কালিবাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে এটি সংস্কার প্রাপ্ত। তবে ঔপনিবেশিক আমলের স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যের চিহ্ন করে গেছে।: মন্দিরটির গঠন শ্রী জয়কালী মন্দিরের অনুরুপ। এর সম্মুখ প্রবেশ বারান্দা লোহার তৈরি অলংকৃত খিলান ও স্তম্ভ যুক্ত। স্তম্ভ গুলোর ক্যাপিটাল কোরিন্থিয়ান রীতির এবং ভীতের অংশ কলস আকৃতির । স্তম্ভের শাফ্ট ‘রোপ’ প্যাটার্ণের। মন্দিরের চারপাশের পিলার গুলো ‘সার্পেন্টাইন ফ্লুটেড’ কলামের প্যাটার্ণে গঠিত। মন্দির সংলগ্ন একতলা ভবনটি খিলান যুক্ত স্তম্ভ দ্বারা বেষ্টিত। খিলানের অর্ধবৃত্তাকার অংশে ফ্যানলাইটের মতো অলংকৃত। মন্দিরের জানালা গুলো উলম্ব যা ‘গথিক’ প্যাটার্ণের খিলান ও ডোরিক কলাম যুক্ত। মন্দিরের একটি প্রাচীন প্রবেশ পথ রয়েছে। যা জরাজীর্ণ। প্রবেশ পথের অর্ধবৃত্তাকার খিলানটি ক্রাউন প্যাটার্ণ বিশিষ্ট।

শ্রী জয়কালী মন্দির :
অভিজাত শেণীর বসতবাড়ির প্রধান ভবনের দুপাশে মোটা পিলারের গঠন ও দুপাশের্^ খিলানের আকৃতি সে সময়ের স্থাপত্যের অনুরুপ কার্নিশের সারিবদ্ধ ‘ডেন্টার ট্রিম’ ব্রাকেট এবং বারান্দার উপরের অংশে ল্যুভর শাটারের ব্যবস্থা ঔপনিবেশিক বৈশিষ্ট্যেকে ইঙ্গিত করে। ছাদের বেষ্টনীর উত্তল অংশ ঢেউয়ের মতো তরঙ্গায়িত। মন্দিরের পাশে একটি নাটমন্দির রয়েছে। যেখানে ধর্মসভা ও প্রতি শুক্রবার কীর্তনের আয়োজন হয়। মন্দির প্রাঙ্গনে শিখর বিশিষ্ট শিবমন্দির রয়েছে,শিখরের কার্নিশের অংশটি অর্ধবৃত্তাকার আকৃতিতে তরঙ্গায়িত এবং ব্রাউন মোল্ডিং যুক্ত। ফ্রিজের অংশে আকর্ষণীয় ফ্লোরাল নকশা বিদ্যমান। এটি পাবনা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। এটি পুনরায় সংস্করণ করায় এর প্রাচীনত্ব কিছুটা চোখে পড়ে। মন্দিরটির বারান্দা লোহার তৈরি অলংকৃত খিলান ও চিকন কোরিন্থিয় রীতির স্তম্ভ দ্বারা বেষ্টিত।

পাবনা সদরের আভিজাত্য শ্রেণীর বসতবাড়ি :
অভিজাত শেণীর বসতবাড়ির
ব্রিটিশ শাসনামলে হিন্দু ব্যবসায়ীরা বৃহদাকৃতির দ্বিতল বা ত্রিতল ববনের নির্মাণ করেছিলেন। যেগুলোর অনেক স্থাপত্যই সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসাবস্থায় রয়েছে। তবে অনেক বসতিই এখনো নতুনত্ব নিয়ে টিকে আছে। কিন্তু ভবন গুলোর মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। যুগে যুগে মালিকানা স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে এর সঠিক মালিকের তথ্য পাওয়া যায় না। ভবনগুলো বর্তমানে বসতবাড়ি,অফিস,স্কুর,সমিতি,সংঘ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।

অভিজাত শেণীর বসতবাড়ির বৈশিষ্ট্য :
এসব ভবন লাল ইট ও পলেস্টারায় নির্মিত। সম্মুখ দরজা-জানালা সব খিলান যুক্ত এবং খিলানে অর্ধবৃত্তাকার রেখা,ডগটুথ, এবং ইটের উলম্ব (টিউডর গথিক)অর্ধবৃত্তাকার নকশা দ্বারা সজ্জিত।৪৫ খিলানে কিস্টোন যুক্ত। পিলার হতে খিলানে উথ্থিত অংশে প্রায়শই ছোট লতানো নকশা চোখে পড়ে।
ক্স কলামের ক্ষেত্রে সাধারণত ডোরিক স্টাইলের মোটা কলাম ব্যবহৃত হয়েছে। সেই সাথে কোরিন্থিয়ান কলামের পাশাপাশি ইসলামিক রীতির কিছু চোখে পড়ে। যেগুলো রসুনের মতো ভিত থেকে উথ্থিত। এছাড়াও ইসলামিক রীতির সাধারণ খিলান ৪৬ সারি ও স্তম্ভরাজি ৪৭ প্রায় প্রতিটি ভবনে দৃশ্যমান।
ক্স মুঘল রীতির ‘ইন্ট্রিকেট জালিকা’ নকশার সচরাচর ব্যবহার হয়েছে সিড়ির রেলিং এ, বারান্দার উপরিভাগের শেডে, বারান্দার রেলিং এ।
ক্স দরজা-জানালা উলম্ব ও ল্যুভর শাটার যুক্ত। জানালার চারপাশে ফ্রেমের মতো করে কোরিস্থিয়ান কলাম যুক্ত ক্ষুদ্রাকৃতির ত্রিকোণ পেডিমেন্ট দেখা যায়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মোটা ডোরিক কলাম যুক্ত অর্ধবৃত্তাকার খিলান ব্যবহার হয়েছে। এছাড়াও জানালায় গথিক খিলানের উদাহরণ পাওয়া যায়।
ক্স ছাদের কার্নিশে সাধারণত ‘ডেন্টাল ট্রিম’ নকশার ব্রাকেটের সারি দ্বারা অলংকৃত।
ক্স ডসড়ি বা বারান্দায় রেলিং এ প্রায়শই ব্রিটিশ রীতির ছাঁচে অলংকৃত লোহার রেলিং এর উদাহরণ মেলে।
ক্স বসতবাড়ি গুলোর ছাদের রেলিং এর প্যাটার্ন সেসময়ে কোলকাতায় নির্মিত বসতবাড়ির রেলিং গুলোর অনুরুপ। যা ছোট ছোট সারিবদ্ধ খিলান নকশা যুক্ত। প্রায়শই রেলিং এর উপর কলাসাকৃতির বুরুজ নির্মিত হতে দেখা যায়।
ক্স ছাদের উপরে পেডিমেন্টের উদাহরণ পাওয়া যায়। যেগুলো ত্রিকোণ ‘ব্রোকেন’ পেডিমেন্ট এবং ‘সেগমেন্টাল’ পেডিমেন্ট বৈশিষ্ট।৪৮

অভিজাত শেণীর বসতবাড়ির বৈশিষ্ট্য :
ক্স ভবনের অভ্যন্তরে দেয়ালের মাঝে উলম্ব আয়তাকার খোপ নির্মাণ করে তাতে আলমারির মতো ব্যবস্থা আছে। পাশাপাশি প্রদীপ মূর্তি বা ধর্মীয় গ্রন্থ রাখার জন্য ছোট কুলুঙ্গিও ব্যবস্থা রয়েছে।
ক্স অলংকরণের ক্ষেত্রে ইসলামিক, গ্রীক, ব্রিটিশ, মুঘলীয় বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। যেগুলো কলাম,কার্নিশ,কার্নিশের নিচের ফ্রিজের অংশে,পেডিমেন্টে,রেলিং ও ইন্ট্রিকেট জালিকা গুলোতে স্থান পেয়েছে।

কয়েকটি বসতবাড়ির উদাহরণ :
ক্স বর্তমান পাবনা মহিলা কলেজের হোস্টেল
ক্স বর্তমান পিয়া টিউটোরিয়াল কোচিং সেন্টার
ক্স বি.এন,পি পার্টি অফিস
ক্স সাতরঙ ড্রইং স্কুল

প্রশাসনিক ও পাবলিক স্থাপত্য সমূহ :

পাবনা জেলা জর্জ কোর্ট :
এটি মূলত পুরাতন কালেক্টরেট ভবন। এটি আদিতে নীল কুঠিয়ালের কুঠি ছিল বলে জানা যায়। প্রায় ১০ বিঘা জমির কেন্দ্রে কুঠিটি অবস্থিত। এই দ্বিতল ভবনটি ১৮৭৯ সালে নির্মিত হয়।৫৪
দ্বিতল ভবনটি পুরোপুরি ব্রিটিশ প্রভাব যুক্ত। এটির সম্মুখে গাড়ি বারান্দা রয়েছে। গাড়ি বারান্দার দুপাশে দোতলায় এবং নিচ তলায় টানা বারান্দা রয়েছে। গাড়ি বারান্দাসহ ভবনের উভয় তলার টানা বারান্দায় খিলানের সারি দ্বারা বেষ্টিত। খিলানগুলো প্রতিটি কিস্টোন যুক্ত। ছাদের কার্নিশের নিচের ফ্রিজে ব্রাউন মোল্ডিং এর সাথে ডেন্টাল ব্যান্ড আকৃতির নকশা করা গাড়ি বারান্দার উপওে ক্ষুদ্র স্তম্ভ যুক্ত নিচু রেলিং এর ছাদ রয়েছে। সিড়ি ও দোতলার রেলিং ব্রিটিশ রীতিতে লোহার নির্মিত। ছাদের বেষ্টনীর উপর কলসী বুরুজ যুক্ত।
ভবনের শীর্ষে সেগমেন্টাল পেডিমেন্ট রয়েছে। যার উপর স্ট্যাকো নকশা করা। যেখানে কেন্দ্রে দাড়িপাল্লা,যার পাদদেশে দুপাশে দুটি তলোয়ার উঠে গেছে। পাল্লার দড়ির দুপাশে একজোড়া করে চারটি ঢাল উৎকীর্ণ। এর চারপাশে ফ্লোরাল নকশা দ্বারা বর্ডার দেয়া। পেডিমেন্টের শীর্ষে ত্রিকোণার সূচালো গঠনের মাঝে প্রদীপের প্রতীক রয়েছে। বারান্দার ‘ওয়াকওয়ে’ তে খিলানযুক্ত পথ তৈরি করা হয়েছে।

পাবনা জেলা স্কুল : প্রশাসনিক ভবনের গঠনে ব্রিটিশ রীতি লক্ষণীয়। পাবনা জেলা স্কুলের প্রশাসনিক ভবনের সামনের বারান্দার প্রবেশ পথের সামনের চারটি কলাম ডোরিক রীতিতে তৈরি। বারান্দার পিছনের অংশে ভবনের প্রবেশ দ্বার রয়েছে। যার উপরের অংশ অর্ধবৃত্তাকার এবং ফ্যানলাইট যুক্ত। এটি ১৮৫৩সনে স্থাপিত।
এডওয়ার্ড কলেজ : ভবনের বারান্দাগুলো সারিবদ্ধ খিলান যুক্ত। কিছু ভবনের সামনে গাড়ি বারান্দার মতো কাঠামে রয়েছে। যেগুলোর সামনে দুটি করে পিলার রয়েছে। যেগুলো সারপেন্টাইন ফ্লুটেড কলামের অনুরুপ। ভবনগুলোর ছাদের অংশে শিখরসহ গম্বুজ যুক্ত ক্ষুদ্র স্তম্ভের কাঠামো পলিক্ষিত হয়। ১৮৯৮ সালে গোপাল চন্দ্র লাহিড়ী এটি প্রতিষ্ঠা করেন।
অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরী : তাঁতিবন্দের জমিদার বরদা গোবিন্দ চৌধুরীর দত্তক পুত্র অন্নদা গোবিন্দ চৌধুরী ১৮৯০ সনে এটি প্রতিষ্ঠা করেন।৫১ পূর্বে এটি দ্বিতল ভবন ছিলো। যার নিচ তলা অর্ধবৃত্তাকার খিলান সারি যুক্ত ছিলো এবং ভবনের চারপাশে ছোট দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত ছিলো,যার উপরের অংশ ‘ইন্ট্রিকেট জালি’ দ্বারা সজ্জিত ছিলো। ভবনের প্রবেশ পথের কেন্দ্রীয় খিলানের উপর ক্ষুদ্র আয়তাকার কাঠামোর উপর ক্ষুদ্রাকারে ত্রিকোণ পেডিমেন্ট লক্ষ করা যায়। বর্তমানে বহুবার সংস্করণের ফলে পূর্বের গঠনটি পুরোপুরি পরিবর্তন ঘটেছে।
জুবিলি ট্যাংক : পাবনা শহরের কালাচাঁদ পাড়ায় ঔপনিবেশিক শাসন আমলে নির্মিত পুষ্করিণী জুবিলি ট্যাংক অবস্থিত। এই বৃহৎ পুকুরটি তাঁতিবন্দের জমিদার পরিবারের বিজয়গোবিন্দের বৈমাত্রেয় ভাই অভয় গোবিন্দ খনন করেন। তৎকালীন মহারানী ভিক্টোরিয়ার রাজত্বকালের সিলভার জুবিলি স্মরণে ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে পাবনা শহরে আদর্শ পানীয় জলের পুকুর খনন করা হয়। লক্ষীনাথ প্রামাণিক আর্থিক সহায়তা দান করায় জলাশয়টি লক্ষীসাগর নামেও পরিচিত।৫২ জুবিলি ট্যাংকের চারদিকে চারটি সিড়িযুক্ত শান বাঁধানো ঘাট আছে। উত্তর দিকে প্রধান ঘাটটি অবস্থিত। প্রধান ঘাটের সাথে একটি দ্বিতল ভবন রয়েছে। নিচ তলার অংশটির চার পাশে কিস্টোনযুক্ত খিলান দ্বারা বেষ্টিত। পাশ দিয়ে দোতলায় ওঠার সিড়ি রয়েছে,যার লোহার রেলিং ব্রিটিশ প্রভাব যুক্ত। প্রধান ঘাটের দুপাশে সম্মুখে ডোম বিশিষ্ট ক্ষুদ্র স্তম্ভ যুক্ত আছে।

নীল কুঠি : পাবনা শহরের শেষ প্রান্তে সাধুপাড়াতে অবস্থিত। যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ধ্বংসপ্রাপ্ত কুঠির দেয়াল ও স্তম্ভের ভগ্নাংশ ও অজ¯্র ভাঙ্গা ইটের টুকরো। পূর্বে এটি ছিলো প্রশস্ত সিড়িযুক্ত জাঁকালো ভবন। এটি অষ্টাদশ শতকে নির্মাণ করা হয়।৫৩ বর্তমানে ইটে নির্মিত তিনটি কোরিন্থিয় রীতির অলংকৃত ক্যাপিটাল যুক্ত স্তম্ভ দন্ডায়মান রয়েছে।

পাবনা সদরের মন্দিরের স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য : এ অঞ্চলের মন্দিরের দুধরণের গাঠনিক বৈশিষ্ট লক্ষ্য করা যায়। একটি হলো কুড়ে ঘর আকৃতির,যেগুলো লাল ইটে নির্মিত ও টেরাকোটা দ্বারা সজ্জিত। আপরটি চারকোণা আকৃতির ও ইসলামিক বৈশিষ্ট্য যুক্ত। যেখানে ইসলামিক মোটিফের অলংকরণ এবং স্তম্ভের সারি বিশিষ্ট বারান্দা বা প্রাঙ্গন লক্ষণীয।

উপসংহার : মুঘল আমলেরও আগে থেকে এই অঞ্চলে অভিজাত শেণীর বসবাস ছিলো। যেগুলো চিহ্ন প্রায় বিলিনের পথে। স্থাপত্যসমূহ মাটির নিচে দেবে যেতে শুরু করেছে এবং উচ্চতা হ্রাস পেয়েছে। তবে ১৮ ও ১৯ শতকের স্থাপত্য গুলো অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শাসনামলের স্থাপত্যগুলো এখনো নতুনত্ব নিয়ে টিকে আছে। এলাকার মানুষের প্রচেষ্টায় এবং প্রশাসনিক স্বার্থে সরকারি কাজে ব্যবহৃত হওয়ার ফলে এ সকল স্থাপত্য বেশ ভালো ভাবেই সংরক্ষিত হচ্ছে। পাশাপাশি কিছু প্রত্নতাত্তিক বিভাগের আবদান চোখে পড়ে। যদিও কিছু দুষ্কৃতিকারীর চক্র এবং পাবনা সদরের অন্তর্গত গ্রামীণ মানুষ তাদের কাজে এসব স্থাপত্য ব্যবহার করায় এবং প্রতœতাত্তিক বিভাগের যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে এই সকল ঐতিহাসিক বেশকিছু নিদর্শন জরাজীর্ণ বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
তবে পাবনা সদরের যে আভিজাত্যতা ছিলো যা কারো চোখে এড়িয়ে যায় না। ৮০০ বছরের পুরাতন এই শহরটি যে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তা এখনো বর্তমান বসবাসকারী নাগরিকরা বহন করছে। এসব পুরাকীর্তি বা স্থাপত্য প্রয়োজনের তাগিদে কালক্রমে সংস্করণের ফলে ঐতিহ্যের বৈশিষ্ট্য কিছুটা ঢাকা পড়েছে। তবুও আজও পাবনা সদরের অভিজাত ঐতিহ্য প্রায় প্রতিটি সড়ক,মহল্লায়,গলিতে গলিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যা ঐতিহ্যগত স্থাপত্যিক প্রেমীদের ছাড়াও সাধারণ জনগণেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে ও কৌতুহল যোগায়।।

মুশ্শারাত তাসনিম মৃদুলা

এম.এফ.এ ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর
২০২০© এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ*
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Smart iT Host