দেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত এম হোসেন আলীর ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের উন্নয়নের সুফল ভোগ করছে বর্তমান প্রজন্ম। কিন্তু তারা এখনও জানেনা দেশের এই সার্বভৌমত্বের নেপথ্যে রয়েছে বাংলা মায়ের কত বীর সন্তান। তাদেরই একজন এম হোসেন আলী। মহান মুক্তিযুদ্ধে কলকাতাস্থ পাকিস্তান দূতাবাসে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তিনি। পরে সেই দূতাবাসেই বাংলাদেশের পতাকা সর্বপ্রথম উত্তোলন করে দেশের জন্য বিরল সম্মান বয়ে এনেছিলেন তৎকালীন কলকাতার এই ডেপুটি হাইকমিশনার। অদ্যবধি উপেক্ষিত রয়ে গেছে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম এই রাষ্ট্রদূতের সকল অবদান।
এম হোসেন আলী ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল পাকিস্তান দূতাবাসের ৬৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলন করেন তিনিই। সেসময় এই ঘটনাটি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ব্যপক আলোচিত হয়। এম হোসেন আলী লাভ করেন বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম রাষ্ট্রদূত হওয়ার দুর্লভ সম্মান।
পতাকা উত্তোলনের ঘটনার পর কলকাতার হাইকমিশনকে বাংলাদেশ মিশন নামকরন করে এম হোসেন আলীকে জ্যৈষ্ঠ কূটনীতিক পদে নিয়োগ প্রদান করে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার। মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে যারা জড়িত তারা সবাই জানেন যুদ্ধে তার অসামান্য অবদানের কথা।
১৯৭০ সালে কুটনীতিক এম হোসেন আলী ভারতের কলকাতাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনে ডেপুটি হাইকমিশনার নিযুক্ত হন। ৭০ এবং ৭১’র শুরুতে পাকিস্তানী শাসকদের কর্মকান্ড তার মনে তীব্র ভাবে আঘাত করে। ৭১’র ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক লক্ষ লক্ষ নিরীহ বাঙালী হত্যার কারনে এম হোসেন আলীর মনে বিদ্রোহ জেগে উঠে। কি করবেন সে বিষয়ে তখনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। তখন দুতাবাসে বাঙালী অবাঙালী মিলিয়ে ১০৫ জন কর্মকর্তা কর্মচারী ছিলেন। তিনি সহ বাঙালী ছিলেন ৬৫ জন। পরিবার সহ বাঙালী কর্মকর্তা কর্মচারীদের সাথে গোপন আলাপ আলোচনা করতে থাকেন। তারা নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন, পাকিস্তান সরকারের অধীনে তারা চাকুরী করবেন না। ইতিমধ্যে ১০ এপ্রিল ভারতে আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ প্রবাসী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রবাসী সরকার শপথ গ্রহণ করলে রাতেই এম হোসেন আলী সিদ্ধান্ত নেন আগামীকাল সকালেই বাঙালীরা বিদ্রোহ করে অবাঙালীদের দপ্তর থেকে বের করে দুতাবাস দখল করবেন এবং প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষনা করবেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ মিশন ছিল প্রবাসী সরকারের প্রধান কেন্দ্রস্থল। এখান থেকেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করা হতো। বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর আশ্রয় প্রদান, তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা সহ প্রয়োজনীয় সকল সামগ্রী সরবরাহে ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র সরবরাহের ব্যবস্থাসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমর্থন, সহযোগীতা এবং কূটনৈতিক তৎপরতার সব কিছু পরিচালিত হতো কলকাতার পার্ক ষ্ট্রীটে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন থেকে। আর দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সকল কর্মকান্ডের নেপথ্য কারিগর ছিলেন মিশন প্রধান এম হোসেন আলী। ছিলেন সকল বিতর্কের উর্ধ্বে।
মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এম হোসেন আলী। দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব নিযুক্ত হন তিনি। এরপর ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত, ১৯৭৬-৭৯ সময়ে জার্মানিতে রাষ্ট্রদূত ও পরে কানাডার হাইকমিশনার নিযুক্ত হন।
সফল কূটনীতিক এম হোসেন আলী ১৯২৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারী পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার পার ভাঙ্গুড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। পিতার নাম তাহের মাহমুদ। অত্যন্ত মেধাবী এই কৃতি সন্তান ১৯৪৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে এমএসসি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৪৮ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি সম্পন্ন করেন। ১৯৪৯ সালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ন হয়ে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগদান করেন।
পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগদানের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত ফরেন সার্ভিস ইনস্টিটিউটে আন্তর্জাতিক আইন ও কুটনীতি শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন। তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরেও কূটনীতি বিষয়ে প্রশিক্ষন গ্রহন করেন। এছাড়া ফ্রান্সের প্যারিসে ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশন্যাল রিলেশন্স থেকে কূটনীতি বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রী অর্জন করেন। চাকুরী জীবনে তিনি ভারত, তুরস্ক, বেলজিয়াম, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ড, বার্মা, অষ্ট্রেলিয়া, জার্মান ও কানাডাতে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন।
দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব নিযুক্ত হন তিনি। এরপর ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত, ১৯৭৬-৭৯ সময়ে জার্মানিতে রাষ্ট্রদূত ও পরে কানাডার হাইকমিশনার নিযুক্ত হন।
১৯৮১ সালে ২ জানুয়ারী কানাডায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে চাকুরীরত অবস্থায় মৃত্যুবরন করেন। পরে তাকে কানাডার অটোয়াতে সমাহিত করা হয়।