একসঙ্গে পরিবারের সাতজন প্রিয়জনকে হারিয়ে আহাজারিতে ভেঙে পড়েছে পুরো একটি গ্রাম। বাড়িতে যাঁদের ফেরার কথা ছিল হাসিমুখে, তাঁরা ফিরলেন কাফনে মোড়া নিথর দেহ হয়ে। প্রবাসফেরত একজনকে আনতে গিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল এক বৃদ্ধা, দুই নারী, দুই শিশু কন্যা ও এক কিশোরীর। জীবিত ফিরে এসেছেন যাঁরা, তাঁরা শুধু বেঁচে থাকার গ্লানি ও শোক বয়ে বেড়াচ্ছেন।
নিহতদের পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, চালকের চোখে ঘুম ছিল। পরিবারের সদস্যরা তাকে বারবার বিশ্রামের অনুরোধ করলেও চালক সে কথা কানে তোলেননি। একপর্যায়ে গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে একটি খালে পড়ে যায়। গাড়িতে আটকে থাকা সাতজনই পানিতে ডুবে প্রাণ হারান। এই দুর্ঘটনার পর পালিয়ে যায় চালক।
ওমানপ্রবাসী বাহার উদ্দিন আড়াই বছর পর দেশে ফিরছিলেন। মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) রাতে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁকে আনতে যান পরিবারের ১১ সদস্য। তাঁকে নিয়ে সবাই মাইক্রোবাসযোগে লক্ষ্মীপুরের উদ্দেশে রওনা হন।
বুধবার (৬ আগস্ট) ভোরে, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলাইয়াপুর ইউনিয়নের পূর্ব বাজার এলাকায় পৌঁছালে, লক্ষ্মীপুর-ঢাকা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে থাকা খালে পড়ে যায় গাড়িটি। স্থানীয়রা জানান, গাড়িটি প্রায় ৩০ মিটার গভীর খালে পড়ে। শুরুতে কিছু সময় ভেসে থাকলেও ধীরে ধীরে গাড়িটি পানিতে ডুবে যায়। ভেতরে আটকে থাকা সাতজন বের হতে পারেননি।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের চৌপল্লী বাজার এলাকার কাশারি বাড়িতে নিহতদের মরদেহ পৌঁছালে শোকের মাতম নেমে আসে। দুপুর থেকেই আশপাশের এলাকার শত শত মানুষ সেখানে জড়ো হন। বিকেলে কাশারি বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে জানাজা শেষে তাঁদের দাফন করা হয়।
নিহতরা হলেন—প্রবাসী বাহারের স্ত্রী কবিতা আক্তার (২৪), মেয়ে মীম আক্তার (২), মা মুরশিদা বেগম (৫০), নানী ফয়জুন নেছা (৭০), ভাবি লাবনী আক্তার (২৫), ভাতিজি রেশমা আক্তার (৯) এবং লামিয়া ইসলাম (৮)। তাঁদের সবাই একই পরিবারের সদস্য।
প্রত্যক্ষদর্শী ও বেঁচে ফেরা স্বজনরা জানান, গাড়িটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ার আগেও চালকের চোখে ঘুমের ঝাপটা স্পষ্ট ছিল। বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও সে বিশ্রাম নেয়নি। দুর্ঘটনার ঠিক আগমুহূর্তে চালক হঠাৎ ঝাঁকি দিয়ে উঠে গাড়ি চালাতে থাকেন এবং কিছুক্ষণ পর নিয়ন্ত্রণ হারান। তিনি নিজে গাড়ির কাঁচ নামিয়ে বের হয়ে গেলেও অন্যদের উদ্ধারে কোনো চেষ্টাই করেননি।
প্রবাসী বাহার উদ্দিন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমার স্ত্রীকে বের করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে মেয়েকে ছাড়া বের হয়নি। মাকে টানতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছি। তিনি নানিকে ছাড়তে চায়নি। গাড়িতে আটকে থেকে তারা সবাই পানিতে তলিয়ে গেল। চালককে অনেকবার বলেছিলাম একটু থামতে, কিন্তু সে কর্ণপাত করেনি। আজ আমার পুরো পরিবার চিরতরে ঘুমিয়ে গেছে।”
বাহারের শ্বশুর ইস্কান্দার মির্জা বলেন, “আমি নিজেও চালক ছিলাম। তাই ওর ঘুম দেখে অনেকবার বলেছি, ‘থেমে চা খাও, বিশ্রাম নাও।’ তবু সে শুনেনি। শেষ পর্যন্ত সেই ঘুমই সাতজনের জীবনের মূল্য চুকিয়ে দিল।”
কাশারি বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এক টিনশেড ঘরের সামনে শোয়ানো শিশুদের মরদেহ ঘিরে স্বজনদের আহাজারি। বাড়ির আরেক ঘরে লাশ রাখা চার নারীর। কেউ বাঁশ কাটছেন, কেউ কবর খুঁড়ছেন, কেউ আবার নিথর দেহগুলো বারবার জড়িয়ে ধরছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহজাহান বলেন, “আমার জীবনে এত মর্মান্তিক ঘটনা দেখিনি। এই চালকের কারণে একটি পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল। চালকদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।”
মুনসুর আহমেদ বলেন, “ঘুমিয়ে গাড়ি চালালে এর পরিণাম ভয়াবহ। আনন্দ করতে এসে সবাই আজ কাঁদছে।”
কবর খননকারী সুমন বলেন, “এতো একসঙ্গে কবর কখনো খুঁড়িনি। আজ মনে হচ্ছে যুদ্ধের সময়কার কোনো গণকবরে কাজ করছি।”
চন্দ্রগঞ্জ হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোবারক হোসেন ভূঁইয়া জানান, “চালকের ঘুম থেকেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। তিনি গাড়ি থেকে পালিয়ে গেছেন। তাঁকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।”
নিহতদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। দুর্ঘটনা সংক্রান্ত তদন্তে পুলিশের পাশাপাশি জেলা প্রশাসনও উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে।
সূত্র: এফএনএস।