ধর্ষণের শিকার হওয়ার আগেই কলেজছাত্রীকে রক্ষা করা, গুরুতর অসুস্থ ট্রেনের যাত্রীকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে পাঠানো এবং খুনিকে হাতেনাতে ধরার মতো অনেক ঘটনা ঘটছে এখন। এটা সম্ভব হচ্ছে ৯৯৯ নম্বরে কল করে। জাতীয় জরুরি সেবার এ হেল্পলাইন নম্বরে বিপদের সময় ফোন করে দ্রুত প্রতিকার পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এ কারণে ক্রমেই ভরসার কেন্দ্র হয়ে উঠছে ৯৯৯। বেড়েছে কলের সংখ্যা। একই সঙ্গে বাড়ছে সেবা প্রত্যাশার ধরনও।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ত্রাণ সহায়তা চেয়ে, ত্রাণসামগ্রী আত্মসাতের অভিযোগ করে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরীক্ষা ও চিকিৎসার তথ্য ও অভিযোগ, ধর্ষণ-যৌন হয়রানি, পারিবারিক সহিংসতা, চুরি-ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধের ব্যাপারে কল পাচ্ছে ৯৯৯। ২০১৭ সালে চালু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত আড়াই কোটি কল এসেছে এই জাতীয় জরুরি সেবা কেন্দ্রে। গত সাত মাসে চার লাখ ৯৯ হাজার ৮৫৮টি কল এসেছে করোনাসংক্রান্ত তথ্য ও সহায়তা চেয়ে।
পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া পৌর এলাকার লক্ষ্মীপুরা মহল্লার হাই স্কুল সড়কের রিপন ব্যাপারীর পরিবারের সঙ্গে পূর্বপরিচয়ের সূত্রে তাঁদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল ১৭ বছরের এক কলেজছাত্রী। গত ২৭ অক্টোবর ভোরে গৃহকর্ত্রী ফিরোজা বেগমের সহায়তায় সোহেল মুন্সী (২৬) নামের এক প্রতিবেশী মেয়েটিকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। মেয়েটি কৌশলে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে সহায়তা চায়। কিছুক্ষণ পর ভাণ্ডারিয়া থানার পুলিশ গিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করে। সোহেল মুন্সী এবং ধর্ষণের চেষ্টায় সহায়তা করার অভিযোগে ফিরোজা বেগমকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ভাণ্ডারিয়া থানার ওসি এস এম মাকসুদুর রহমান বলেন, ৯৯৯ নম্বরে কল পেয়ে পুলিশ তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়। মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সে বলেন, ‘হঠাৎ করেই ৯৯৯ নম্বরে ফোন করার বিষয়টি মাথায় আসে। লুকিয়ে কল করি। পুরো পরিস্থিতি আমার বিপক্ষে ছিল। আমি ফোন করার কয়েক মিনিটের মধ্যে পুলিশ চলে আসে।’
গত ১ নভেম্বর ঢাকার কমলাপুরের উদ্দেশে ছেড়ে আসা লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেনের পরিচালক আক্তারুল ইসলাম ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে জানান, ট্রেনে একজন অসুস্থ নারী যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, তাঁর রক্তপাত হচ্ছে। ট্রেনটি তখন পাবনার ঈশ্বরদীর মুলাডুলি এলাকা অতিক্রম করছিল। আধাঘণ্টার মধ্যে ট্রেনটি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় থামে এবং ওই রোগীকে উল্লাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। ওই নারীর ভাই দোলা মিয়া বলেন, ‘ট্রেনের মধ্যে আমরা কী করব তা বুঝতে পারছিলাম না। তখন ট্রেনের লোক ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে। ট্রেন থামতেই দেখি অ্যাম্বুল্যান্স।’ দোলা মিয়া জানান, বোন রিপুলিকে (২৫) নিয়ে গাইবান্ধার বামনডাঙ্গা থেকে লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেনে ওঠেন তিনি। মাসখানেক আগে গর্ভপাত হয় তাঁর বোনের। তিনি পুরোপুরি সুস্থ হননি। ট্রেনে আসার সময় তাঁর রক্তপাত ও ব্যথা শুরু হয়। দ্রুত চিকিৎসায় রিপুলি সেরে ওঠেন।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুরের পুলপারের হোসেন সাহেবের গলিতে নিজের মুদি দোকানে বসে ছিলেন নজরুল ইসলাম (৪৫)। দুপুরের দিকে দোকানে ঢুকে এক তরুণ তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করতে থাকে। এমন দৃশ্য দেখে তাঁকে উদ্ধার না করে আতঙ্কে লোকজন দৌড়ে পালাতে থাকে। এক পথচারী বুদ্ধি করে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে ঘটনাটি জানান। দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে হামলাকারী রাহাত মিয়াকে হাতেনাতে ধরে ফেলে পুলিশ, তবে ব্যবসায়ী নজরুলকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলেও বাঁচানো যায়নি।
মোহাম্মদপুর থানার ওসি আবদুল লতিফ বলেন, ব্যবসায়ী নজরুল খুনের ঘটনায় ৯৯৯-এ কলের কারণে আসামিকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে।
এ ছাড়া জাতীয় জরুরি সেবার হেল্পলাইন নম্বরে ফোন করে কখনো ছিনতাই হওয়া গাড়ি বা গরু উদ্ধার হচ্ছে; কখনো মাঝনদীতে আটকা পড়া লঞ্চের যাত্রী নিরাপদে তীরে ফিরছে।
৯৯৯ জরুরি সেবা বাংলাদেশ পুলিশের অধীনে পরিচালিত একটি জরুরি কল সেন্টার। এখান থেকে জরুরি পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুল্যান্স সেবা দেওয়া হয়। দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো ব্যক্তি ৯৯৯ নম্বরে কল করার মাধ্যমে এসব জরুরি সেবা নিতে পারবে। সর্বস্তরের নাগরিকদের জরুরি সেবা দিতে ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পুলিশ এই কল সেন্টার সেবাটি চালু করে। সপ্তাহে সাত দিন ২৪ ঘণ্টা চালু রয়েছে এ কল সেন্টার। ৯৯৯ একটি টোল ফ্রি নম্বর। এই নম্বরে কল করার জন্য কলারকে কোনো টাকা খরচ করতে হয় না।
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ বলেন, ‘তিনটি বিষয়ে আমাদের কাজ করার কথা থাকলেও করোনাকালে নতুন পরিস্থিতি নতুন নতুন চাহিদা তৈরি করছে। প্রথমে আমরা শঙ্কিত ছিলাম পারব কি না, তবে আমাদের কিউ টিম ও ট্রেনিং টিম নতুন কৌশল উদ্ভাবন করে মানুষকে তথ্য ও সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। এখন করোনাসংক্রান্ত বিভিন্ন কলের পাশাপাশি পারিবারিক নির্যাতন, ধর্ষণ, অনিয়মসহ বিভিন্ন ধরনের কল আমরা পাচ্ছি। গুজব ও দুর্যোগের তথ্য যাচাইয়েও আমরা কাজ করছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘লালমনিরহাটে গুজবকে কেন্দ্র করে এক ব্যক্তিকে পুড়িয়ে মারার মতো ঘটনাও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ৯৯৯-এ। কেউ যদি কোনো বিষয়ে তথ্য যাচাই করতে চায়, তবে আমরা সেটা পারি। কারণ সারা দেশে সবখানে পুলিশ আছে। এ জন্য আমাদের কাছে ফোন করার জন্য আহ্বানও জানানো হয়েছে।’
করোনায় পাল্টেছে কলের ধরন : সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, চালু হওয়ার পর থেকে গত ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ৯৯৯ নম্বরে দুই কোটি ৫২ লাখ ৮৮ হাজার ২৬টি কল এসেছে। এর মধ্যে এক কোটি ৯৯ লাখ ২৯ হাজার ৪২৯ কল ছিল ভুয়া। সেবা দেওয়ার কল (সিএফএস) ছিল ৫৩ লাখ ৫৮ হাজার ৫৯৭টি। এর মধ্যে সরাসরি সেবা দেওয়া হয়েছে চার লাখ ১৩ হাজার ৭৭টি কলে। এর মধ্যে পুলিশের সেবা দেওয়া হয়েছে তিন লাখ তিন হাজার ৪৮৬ কলে। ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আগুন নেভানোর সেবা দেওয়া হয় ৪৩ হাজার ৫৯৮ কলে। অ্যাম্বুল্যান্স সেবা দেওয়া হয় ৬৫ হাজার ৯৯৩ কলে। গত সাত মাসের এক হিসাবে দেখা গেছে, চার লাখ ৯৯ হাজার ৮৫৮ জন কল করে করোনাসংক্রান্ত তথ্য ও সহায়তা চেয়েছে।
ধর্ষণ-নিপীড়ন ঠেকাতে সহায়তা : করোনাকালে বেড়েছে পারিবারিক সহিংসতা, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগ। ৯৯৯ হেল্প ডেস্কের তথ্য মতে, গত বছর নারী ও শিশু নির্যাতন সহিংসতার ঘটনায় কল এসেছে ছয় হাজার ২৮৯টি। আর চলতি বছরের ১০ মাসেই কল এসেছে সাত হাজার ৭৩৫টি। করোনাকালের শুরুতে মার্চ মাসে ছিল সবচেয়ে বেশি, এক হাজার ১৬৪টি। এর পরে কিছুটা কমেছে। ১ মে থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ছয় মাসে ধর্ষণের অভিযোগ করে ৯৯৯ নম্বরে ২৯৯টি কল আসে। এ সময় ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ করে ১২১ জন এবং যৌন হয়রানির অভিযোগ করে ১৩৩ জন। ছয় মাসে ৫৯৫ জন নারী যৌতুকসহ বিভিন্ন কারণে স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ করেন ৯৯৯-এ।