ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন এখন বাংলাদেশে। প্রথম দফায় ২০ লাখের (উপহার হিসেবে) পর দ্বিতীয় দফায় ৫০ লাখ ভ্যাকসিন এখন বেক্সিমকোর ওয়্যারহাউসে রাখা আছে। ২৭ জানুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভ্যাকসিন প্রয়োগের শুভ উদ্বোধন (ভার্চুয়ালি) করেন। ভ্যাকসিন সংগ্রহে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের চেয়েও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। এ জন্য অবশ্যই ভারত সরকারের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
প্রতিটি ভ্যাকসিনেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে—এই ভ্যাকসিনটিও ব্যতিক্রম নয়। তাই প্রয়োগের পরপরই ঠাণ্ডা, জ্বর, গলা ব্যথাসহ নানা ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। নরওয়েসহ অনেক দেশে মৃত্যুবরণও করেছে। ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞদের মতে, কার্যকরী একটি ভ্যাকসিন তৈরি করতে ১০-২০ বছর সময় লাগে। অর্থাৎ ধীরে-সুস্থে এবং বারবার পরীক্ষা ও প্রয়োগ করে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বুঝতে হয়, ফলে অনেক সময় অতিবাহিত হয়। বর্তমান ভ্যাকসিনটি মাত্র এক বছরের মধ্যেই তৈরি হয়েছে। যদিও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনক্রমেই তা বাজারে এসেছে। করোনার কারণে দীর্ঘ ১১ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় চরম ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা খাত। সম্প্রতি গণসাক্ষরতা অভিযানের ‘এডুকেশন ওয়াচ ২০২০-২০২১’-এর এক সমীক্ষায় ফুটে উঠেছে যে দেশের ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসে ফিরতে চায়। ৭০ শতাংশ অভিভাবক ও ৭৩ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাও স্কুল খুলে দেওয়ার পক্ষে। জাতীয় সংসদের মাননীয় সংসদ সদস্যরাও ফেব্রুয়ারির মধ্যেই স্কুল খুলে দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিচ্ছে জোরেশোরে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) নির্দেশনা পেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হাত ধোয়ার বেসিন স্থাপন, সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্বাস্থ্যবিধি, শারীরিক দূরত্বের বিধি, হাত ধোয়ার সঠিক নিয়ম, মাস্ক পরার নিয়ম, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচারও টাঙানো হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোতে। সব প্রস্তুতি ৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সম্পন্ন করার জন্য বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জারি করা নির্দেশনা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনেসকো, ইউনিসেফ, বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক নির্দেশনা অনুসরণ করে ‘কভিড-১৯ পরিস্থিতি বিবেচনায় জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার চালুর নির্দেশনা জারি করা হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও। এদিকে ইউজিসির সূত্র মতে, স্কুল-কলেজের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও খুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন। মার্চ মাসের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোও ধীরে ধীরে খোলা হবে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সরকারের সব বিধি-নিষেধ মেনে পর্যায়ক্রমে যথাযথ উদ্যোগ নেবে এমনটিই প্রত্যাশা। তবে শুরুর দিকে প্রাথমিক স্তরে পঞ্চম ও চতুর্থ শ্রেণি, স্কুল পর্যায়ে নবম-দশম শ্রেণি, কলেজ পর্যায়ে সর্বশেষ ব্যাচ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে স্নাতকোত্তর কিংবা চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু করে সপ্তাহে দু-তিন দিন করে দু-তিনটি ক্লাস নেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে একাধিক শিফট চালু করা যেতে পারে। সার্বিক পরিস্থিতি ভালো মনে হলে পর্যায়ক্রমে সব শ্রেণির বা বর্ষের সবগুলো ক্লাস শুরু করা যাবে।
সব দেশেই ভ্যাকসিন ব্যবহারে বয়স্ক, অসুস্থ ব্যক্তি, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এসব প্রথম সারির করোনাযোদ্ধাদের টিকা দেওয়ার পর জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের করোনা টিকা দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) থেকেও এই আহ্বান জানানো হয়েছে। কাজেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন দেওয়ার উদ্যোগ নিলে শিক্ষা কার্যক্রম পুরোদমে এবং দ্রুত শুরু করা সম্ভব হবে। অবশ্য ভ্যাকসিন না পাওয়া পর্যন্ত বিকল্প হিসেবে মাস্ক পরিধান করা, স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা উচিত হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে, যা প্রথমটি থেকেও মারাত্মক। তাই আমরা নিরাপদে বেঁচে থাকব, নাকি কবরে যাব—এই দায়িত্ব সম্পূর্ণ কর্তৃপক্ষের ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না। অবশ্যই কর্তৃপক্ষ তার সাধ্যমতো নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করবে। কিন্তু আমাদেরও নিজ নিজ অবস্থান থেকে সাবধান ও সচেতন থাকতে হবে। একদিকে ভ্যাকসিন প্রয়োগের সুখবর, অন্যদিকে দীর্ঘ প্রায় এক বছর পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে যাচ্ছে, এ খবর শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সর্বমহলে প্রশংসিত হচ্ছে। আমরাও করোনা ভ্যাকসিনের প্রয়োগ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই।
লেখক : অধ্যাপক ও পরিচালক, আইআইটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।