জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকারের সকল স্তরের নির্বাচনে ভোট গ্রহণের আগাগোড়া পুরো দায়িত্বে থাকেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এরমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও থাকেন। ভোট কেন্দ্রে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-এমনকি মাদ্রাসার শিক্ষকরাও থাকেন। তবে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না হলে ভোটে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলো কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা একে অপরকে দোষেন। নির্বাচন সুষ্ঠু করার দায়িত্ব যাদের, তাদের নিয়ে তর্কের বদলে দলগুলো অভিযোগ খাড়া করেন পরস্পরের বিরুদ্ধে।
রাজনীতি বিশ্লেষক, নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বাচন কমিশনের তদারকি ও নির্দেশনায় নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার দায়িত্ব কার্যত প্রশাসনের। ভোটকেন্দ্রের সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষা ও অবাধ ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকলে ভোটকেন্দ্র দখল, জালভোট প্রদান, জোর করে ব্যালটে সিল মারা, কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর এজেন্টকে কেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়া ও কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটার কথা নয়। সুষ্ঠু পরিবেশের অভাবেই পুরো নির্বাচন ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে।
নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্তরা বলছেন, সরকারি কর্মকর্তাদের যারা ভোটকেন্দ্রে ভোট গ্রহণের দায়িত্বে থাকেন তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ও ভোট সুষ্ঠু হওয়া না হওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। মাদ্রাসার যেসব শিক্ষক কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করেন তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ও ভাবনার বিষয়। তাছাড়া একটি কেন্দ্রে প্রশাসনের যারা দায়িত্বে থাকেন তাদেরকে কোনো প্রার্থী আপ্যায়ন করার, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাদের সঙ্গে কার কী ধরনের লেনদেন হয় সেটিও ভোট সুষ্ঠু হওয়া না হওয়ায় প্রভাব ফেলে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ এ বিষয়ে ইত্তেফাককে বলেছেন, ‘এই পরিস্থিতির কেউ তো কোনো দায় নিচ্ছে না। মূল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রধান কাজই যেন পুলিশকে কে কার পক্ষে নিতে পারবেন-সেই প্রতিযোগিতা করা। প্রশাসনকে যে যেভাবে ম্যানেজ করতে পারছে ফল সেদিকেই যাচ্ছে। এখন আমাদের চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই। ভোটের কোনো নিয়ম-কানুন বলতে কিছু আছে বলে আর মনে হয় না। এ নিয়ে কারো মাথাব্যথা আছে বলেও মনে হচ্ছে না। যেতে-যেতে অধঃপতনের কোন পর্যায়ে যেতে পারে সেটাই এখন দেখার বিষয়।’
নির্বাচনি আইন অনুযায়ী, ভোটারকে ব্যালট পেপার দেওয়ার আগে ব্যালটের অপর পৃষ্ঠায় অফিসিয়াল সিলের ছাপ দিতে হয়। সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ব্যালটের পেছনে অনুস্বাক্ষর করেন। এই সিলের একটি কোড বা গোপন সংকেত নম্বর থাকে। ব্যালট পেপারের মুড়িপত্রে ভোটার তালিকায় প্রদত্ত ভোটারের ক্রমিক নম্বর লেখা থাকে। ব্যালট পেপারের মুড়িপত্রে ভোটারের স্বাক্ষর বা টিপসইও নেওয়া হয়। তারপর মুড়িপত্রে অফিসিয়াল সিল দ্বারা ছাপ দিতে হয়। এরপর ভোটার গোপন বুথে গিয়ে পছন্দের প্রতীকে বর্গাকৃতির রাবারস্ট্যাম্প দ্বারা ছাপ দেন। আর এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিই সম্পন্ন করেন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসনের লোক জন। ইভিএমে ভোট হলেও নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়।
নির্বাচন কমিশনের হিসাব মতে, সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে সাধারণ ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৪ জন সদস্য মোতায়েন থাকেন। এর মধ্যে অস্ত্রসহ পুলিশ এক জন, অস্ত্রসহ আনসার এক জন, অস্ত্র/লাঠিসহ আনসার এক জন, লাঠিসহ আনসার সদস্য ১০ জন (পুরুষ ছয় জন ও মহিলা চার জন) ও গ্রাম পুলিশ এক জন। মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে অস্ত্রসহ পুলিশ দুই জন, অস্ত্রসহ আনসার এক জন, অস্ত্র/লাঠিসহ আনসার এক জন, লাঠিসহ আনসার সদস্য ১০ জন (পুরুষ ছয় জন ও মহিলা চার জন) ও দুই জন গ্রাম পুলিশ মোতায়েন থাকেন। আর মেট্রোপলিটন এলাকায় সাধারণ ভোটকেন্দ্রে ১৫ জন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ১৭ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকেন। এর বাইরে র্যাব ও পুলিশের টহলও থাকে।
নির্বাচনি আইন অনুযায়ী, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে এক জন প্রিজাইডিং অফিসার, প্রতি বুথে এক জন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও প্রতি বুথে দুই জন করে পোলিং অফিসার নিযুক্ত থাকেন। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি কেন্দ্রে প্রতিটি বুথে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রত্যেক প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট থাকবেন। তবে কারো এজেন্ট না থাকলেও গণ প্রতিনিধিত্ব আদেশের ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচনি কর্মকর্তার সব কার্যক্রম আইনসিদ্ধ বলে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে কোনো প্রার্থী কিংবা তার এজেন্টরা ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত না থাকলে সেটির দায়-দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন কিংবা অন্য কোনো প্রার্থীর নয়।