বেশ কিছুদিন যাবত দেশের মধ্যে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা প্রভাব বিস্তার করছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। রাজনীতির বল কখনো এক দলের কোর্টে, কখনো ভিন্ন দলের কোর্টে। এক দল চেষ্টা করছেন অন্য দলকে কৌশলে দমিয়ে রাখতে, আবার অন্য দল হয়তো চেষ্টা করছেন ভিন্ন দলকে ছাড়িয়ে যেতে। মোটকথা, রাজনীতির মাঠ এখন সরগরম। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট কোন দিনক্ষণ ঠিক না হলেও ছয় সাত মাসের ভেতরে নির্বাচন যে দিয়ে দেওয়া হবে-এটি মোটামুটি পরিষ্কার ভাবে প্রতিয়মান হচ্ছে। আর এই নাজুক সময়টাতে প্রত্যেকটি দল চাচ্ছে তার ভাবমূর্তি সুন্দর রাখতে। আবার প্রতিযোগী দল কর্তৃক বিভিন্ন কৌশলে সেই ভাবমূর্তি নষ্ট করার পায়তারাও আমরা দেখছি।
এই মুহূর্তে দেশের সবচাইতে বৃহৎ ও কার্যকর দলটি হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। খুব ব্যতিক্রম কিছু না হলে, পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করবে- একথা বোধ হয় নিশ্চিত করেই বলা যায়। সম্প্রতি গবেষণা সংস্থা ‘সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং’ (SANEM) এবং’ইনভিশন কনসাল্টিং’ এর চালানো জরিপ দুটোতেও বিএনপির জনপ্রিয়তা সম্পর্কে এমন ধারণাই পাওয়া গিয়েছে। সুতরাং বিষয়টি শুধু মুখে মুখে নয় বরং গবেষণার হিসাব-নিকাশেও প্রমাণিত। এর ফলশ্রুতিতে বিএনপি সুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি কিছু অবধারিত অসুবিধার মধ্যে পড়েছে। সুবিধার মধ্যে রয়েছে -নেতাকর্মীদের মনোবল বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি, সঙ্গত কারণেই মিডিয়া কাভারেজ বেশি পাওয়ার সম্ভাবনা এবং উত্তরোত্তর জনসমর্থন বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা।
দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি ভোটারদের একটা বড় অংশ থাকে ভাসমান। এই ভাসমান ভোটাররা অনেকটা ঝোঁকের মাথায় ভোট দেয়। সাধারণত যে দলের জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, এই ভোটারগুলোর অধিকাংশই সেদিকেই ঝুঁকে পড়ে এবং ভোট দেয়। ফলে ‘উত্তরোত্তর জনসমর্থন বৃদ্ধি পাওয়া’ – এটি একটি অন্যতম সুবিধা যা বিএনপি সাম্প্রতিক দুটি জরিপের প্রকাশিত ফলাফল থেকে পাচ্ছে। এবার আসি অসুবিধায়। জনপ্রিয় দল হিসেবে প্রমাণিত হওয়ায় বিএনপি যে অসুবিধাগুলোর সম্মুখীন হচ্ছে তা হলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নজরদারি বৃদ্ধি, প্রত্যাশার চাপ, বিভিন্ন কর্মসূচির উপর অতিরিক্ত নজরদারি ইত্যাদি। তবে সবচাইতে বড় যে অসুবিধার মুখে বিএনপি পড়েছে তা হল, প্রতিপক্ষ দলগুলোর আরো কঠোর ও কৌশলী অবস্থান গ্রহণ। এই মুহূর্তে বিএনপির পরেই জনপ্রিয় যে দলগুলো আছে তাদের মধ্যে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, তরুণদের দল এনসিপি ও জাতীয় পার্টি। এই দলগুলো জনপ্রিয় হলেও সে জনপ্রিয়তা বিএনপির কাছাকাছি নয়। বাকি দলগুলো নামসর্বস্ব। এই দলগুলোর অধিকাংশেরই ‘হারানোর কিছু নেই’। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির অসাধারণ অর্জনের কারণে হারানোর অনেক কিছু আছে! ঠিক এই কারণটাতেই অন্যান্য দল যেভাবে বলতে পারছে বা কাজ করতে পারছে সেটা বিএনপি পারছেনা। তাদের অনেক কিছু ভাবতে হচ্ছে। এই সুযোগে সুযোগ সন্ধানী (সবক্ষেত্রে নয়) ব্যক্তি, দল বা প্রতিষ্ঠান, এই সুবৃহৎ দল বিএনপিকে বিভিন্ন কৌশলে বা অপকৌশলে, বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন জায়গায় বিপদগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ও কার্যকর গণতান্ত্রিক দল হওয়ার কারণে দেশের কাছে বিএনপির কিছু ‘দায়’ আছে, আছে কিছু ‘করণীয়’ও। এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে এই মুহূর্তে বিএনপির কি করা উচিত?
এই মুহূর্তে এই ঘোরতর সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য বিএনপির কয়েকটি পদক্ষেপ জরুরিভাবে নিতে হবে।
১। বিএনপি নিঃসন্দেহে একটি গণতান্ত্রিক দল। এর আগে দেশ শাসন করার অভিজ্ঞতা তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই পেয়েছিল। এই গণতান্ত্রিক দলের প্রাণ-ভোমরা হলো বেগম খালেদা জিয়া। তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আপসহীন মনোভাবের কারণে দেশে ও দেশের বাইরে সমানভাবে সমাদৃত ও সম্মানিত। শুধু বিএনপি নয়, পতিত আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী সহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ এবং দেশের আপামর জনতা বেগম খালেদা জিয়াকে অত্যন্ত সমীহ করে। বেগম খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকলেও, তার ‘উপস্থিতি’ও বাংলাদেশের পরিস্থিতি কে প্রভাবিত করার জন্য যথেষ্ট। শুধু তাই নয়, এই দেশে এমন কিছু মানুষও রয়েছে যাদের জিজ্ঞেস করলে এমন উত্তর দেয়, ‘আমি ম্যাডাম জিয়ার দল করি’! এমন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা বাংলাদেশের ইতিহাসে খুব কম মানুষেরই ছিল বলে মনে হয়। বিএনপির উচিত বেগম খালেদা জিয়ার এই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে তাদের জনসমর্থন বৃদ্ধি করা।
শুধু তাই নয়, এমন বহু ইউনিট আছে যেখানে বেগম খালেদা জিয়ার হস্তক্ষেপ ছাড়া শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়। সুতরাং শৃঙ্খলা সংক্রান্ত ব্যাপারে বিএনপির উচিত সর্বক্ষেত্রে বেগম খালেদা জিয়ার পরামর্শ নিয়ে তাকে সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট করা। অসুস্থ থাকলেও বেগম জিয়া বিগত বছরগুলোতে যে মনোবল দেখিয়েছেন, এই মুহূর্তে দলের নীতি নির্ধারণী বিষয়গুলোর সিদ্ধান্ত উনি যে সঠিকভাবে নিতে পারবেন-এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকার কারণ নেই। বেগম খালেদা জিয়া যদি নিয়মিত, সরাসরি না হোক অন্তত ভিডিও বার্তায়, নেতাকর্মীদের নির্দেশনা মিডিয়ার বদৌলাতে দেন, তাহলে জনসম্পৃক্ততা, জনপ্রিয়তা এবং শৃঙ্খলা প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী হবে- এটি নিশ্চিত।
এছাড়াও আগামীতে, দেশের অন্য কোথাও না হোক, অন্তত ঢাকাতে দুই-একটি জনসভায় বেগম খালেদা জিয়াকে স্বশরীরে উপস্থিত করার চেষ্টা করতে হবে। এটি করতে পারলে দলীয় নেতাকর্মীদের মনোবল বেড়ে যাবে কয়েকগুণ এবং বিএনপির প্রতিপক্ষরা, যদি কেউ অপকৌশলে বিএনপিকে বিপদে ফেলতে চায়, তারা স্পষ্টই অবদমিত হবে।
বিশ্বের ইতিহাসে অসুস্থতা নিয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার বহু নজির আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট হুইল চেয়ারে বসে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল, ভারতের মহাত্মা গান্ধী ও ইন্দিরা গান্ধী, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা অসুস্থ অবস্থায় দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এছাড়াও ভেনেজুয়েলার হুগো শ্যাভেজ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েও দীর্ঘদিন দেশের নেতৃত্বে দিয়েছেন। আধুনিক তুরস্কের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা আতাতুর্ক মোস্তফা কামাল লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়েও দীর্ঘদিন দেশের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বেগম খালেদা জিয়ার বর্তমান বয়স ৭৯বছর। এই বয়সের চেয়ে অনেক বেশি বয়সে পৃথিবীর অনেক শাসক তাদের দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সৌদি আরবের কিং সালমান (৮৮), ক্যামেরুনের পল বিয়া (৯২), ফিলিস্তিনের মাহমুদ আব্বাস (৮৯) তাদের অন্যতম। মাহাথির মোহাম্মদ শেষ বার কত বছর বয়সে মালয়েশিয়ার হাল ধরেছিলেন- আমরা সবাই তো জানি! বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ডঃ মোঃ ইউনূসের বয়স কিন্তু ৮৫!
সুতরাং দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে, অসুস্থতা ও বয়স বিবেচনায় বেগম খালেদা জিয়াকে নেতৃত্বের শীর্ষে সরাসরি না নিয়ে আসার ব্যাপারে মতামত প্রকাশের জোরালো সুযোগ নেই! বিশেষ করে তারেক রহমান দেশে এসে সরাসরি দেশের রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হওয়ার আগ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া অবশ্যই জরুরী।
২। বিএনপি-তে ‘নেক্সট টু বেগম খালেদা জিয়া’ ‘অনলি ওয়ান নেক্সট টু বেগম খালেদা জিয়া’ যদি কেউ থেকে থাকেন, তিনি হলেন তারেক রহমান যিনি অত্যন্ত মেধাবী এবং তরুণদের মনের ভাষা বোঝেন, তাদের সাথে মিশতে পারেন। যেহেতু সরাসরি মিছিল-মিটিংয়ে বেগম খালেদা জিয়ার সার্বক্ষণিক অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত, সেহেতু এই মুহূর্তে এই দলটির ওই ধরনের অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণের জন্য তারেক রহমানকে সরাসরি উপস্থিত থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। দলীয় নেতাকর্মীদের সমর্থন এবং ভোট পাওয়ার ব্যাপারে তারেক রহমানের উপস্থিতি তেমন জরুরী নয়, তবে ভাসমান ভোটার গুলোকে (যারা অনেক সময় নির্বাচনে জয় পরাজয় নির্ধারণ করে দেয়) প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে তারেক রহমানের চাইতে বেশি প্রভাব বিএনপি’র নেতৃস্থানীয় অন্য কোন ব্যক্তির পক্ষে বিস্তার করা সম্ভব না। যার ফলে তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এখন সময়ের দাবি। তবে হ্যাঁ, তারেক রহমানের নিরাপদ জীবনধারণ, এবং কর্মকান্ডের নিশ্চয়তা শতভাগ পূরণ করেই সামনে এগোনো উচিত হবে।
বিএনপিকে মাথায় রাখতে হবে তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে দুটি ‘ফ্যাক্টর’ আছে। ‘ফ্যাক্টর’ দুটি হল- ‘নিরাপত্তা’ এবং ‘সময়’। সামনে যেহেতু আপাতদৃষ্টিতে নির্বাচনের বেশি সময় নেই কিন্তু সাংগঠনিক অনেক কাজ বাকি, তাই নিরাপত্তার বিষয়টি অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ-পরামর্শ করতে হবে, দাবী জানাতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তারেক রহমানকে দ্রুত দেশে ফিরে দেশব্যাপী সাংগঠনিক সফরের ব্যবস্থা করতে হবে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ঠিক যে ‘মডেলে’ মানুষের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন ঠিক একই ‘মডেলে’ তারেক রহমানকে সাংগঠনিক সফর করে মানুষের কাছে সরাসরি যেতে হবে তাদেরকে এই আশ্বস্ত করতে যে ‘জিয়া ইজ ব্যাক’!
৩। আমি ব্যক্তিগত ভাবে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজের জন্য শাস্তির বিরুদ্ধে নই। তবে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজের জন্য নেতাকর্মীদের বহিষ্কার বা অন্যান্য শাস্তি দেয়াটাই যথেষ্ট নয়। এতে উপকার অপকার দুটোই আছে। উপকারটি হল শাস্তির ফলে সমজাতীয় অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই সচেতন হয়ে সঠিক পথে থাকবে, দলীয় শৃঙ্খলা ফিরবে, নেতৃত্ব সুদৃঢ় হবে এবং দলের ভিতরে কোন্দল নিরসন করা যাবে।
অপকারের পাল্লাটা কিন্তু বেশ ভারী! শৃঙ্খলা বিরোধী কর্মকান্ডে শাস্তির ফলে দলের ভেতরে বিভাজন তৈরি হয়। অনেক জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য নেতা তার অবস্থান হারিয়ে ফেলে যার প্রভাব পড়ে ভোটে। সবচেয়ে বড় অসুবিধাটা হলো শাস্তিপ্রাপ্ত নেতাকর্মীদেরকে বিরোধীপক্ষ বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে যার ফলে অনেক সময় দলের বড় ধরনের ক্ষতি হয়, সার্বিকভাবে না হলেও তৃণমূল পর্যায়ে হয়। তাছাড়া বারবার শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দলীয় শৃঙ্খলাহীনতার বিষয়টি প্রমাণ করে।
শেষ কথা, এই মুহূর্তে এই দেশের হাল ধরার জন্য বিএনপিকে পুরোপুরি প্রস্তুত হতে হবে- কৌশলে, শক্তিতে, কাজকর্মে, কথাবার্তায় ইত্যাদিতে। কৌশল এবং শক্তির আদর্শ অনুপাতে এগিয়ে যাওয়াটাই এই মুহূর্তে বিএনপির সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
শৃঙ্খলাহীন বাংলাদেশকে সাধারণ মানুষ আর দেখতে চায় না, তাদের অনেক বড় দাবি আছে সময়ের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দল বিএনপির কাছে!
লেখক: এস এম নাহিদ হাসান
সাবেক ছাত্র নেতা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।