গণমানুষে প্রতিনিধিত্ব ও সরকারের স্থিতিশীলতা বিবেচনায় নির্বাচনের বিদ্যমান ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (এফপিটিপি) এবং আলোচিত প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতির চেয়ে মিক্সড মেম্বার পিআর (এমএমপি) পদ্ধতি উত্তম বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মুহাম্মাদ মামুনুল হক।
নিউজিল্যান্ডসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই এই পদ্ধতি প্রচলিত আছে এবং এটি চলমান বিতর্ক নিরসনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির শফিকুল কবির মিলনায়তনে ‘জনমতের প্রতিফলনে কার্যকর নির্বাচনব্যবস্থা: এমএমপি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে মূল বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
মামুনুল হক বলেন, ইসলামে শাসক নির্বাচনের স্বতন্ত্র ব্যবস্থা রয়েছে, যা নিঃসন্দেহে সকল ব্যবস্থার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম। ইসলামী ব্যবস্থা কার্যকর না থাকায় এখন বিকল্প হিসেবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির নির্বাচনকে মন্দের ভালো হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানারকম নির্বাচনব্যবস্থা রয়েছে। তন্মধ্যে আমাদের দেশে বর্তমানে কার্যকর রয়েছে এফপিটিপি পদ্ধতি। সম্প্রতি বিভিন্ন মহল ও রাজনৈতিক দল ও পক্ষসমূহ পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি তুলেছে।
উভয় পদ্ধতির নানারকম দুর্বলতা ও আমাদের বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং গণমানুষের মতামতের প্রকৃত প্রতিফলনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস তৃতীয় পদ্ধতি তথা এমএমপিআর প্রস্তাব করেছে। এটিই তুলনামূলকভাবে শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হতে পারে। এতে জনমতের সঠিক প্রতিফলন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ভোটারের ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে।
তিনি বলেন, এফপিটিপি পদ্ধতিতে প্রতিটি আসনে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পায়, সে-ই জয়ী হয়। এর সুবিধা হলো-সহজ ও দ্রুত ফলাফল। স্থিতিশীল সরকার গঠন সহজ (বেশি আসন পাওয়া দলই সরকার গঠন করে)। স্থানীয় প্রতিনিধিত্ব জোরদার হয়।
অসুবিধা হলো-ভোট ও আসনের অনুপাতে অমিল (একটি দল ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে ৬০ শতাংশ আসন পেতে পারে)। ছোট দল ও সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব কম। বহু ভোট “ব্যর্থ’ হয় (যারা জয়ী না, তাদের ভোট বাদ পড়ে)।
পিআর পদ্ধতিতে ভোটের শতকরা হারে দলগুলো আসন পায়। এর সুবিধা হলো-ভোটের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে। সংখ্যালঘু ও ছোট দলগুলোও সুযোগ পায়। এটি ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক। তবে অসুবিধা হলো-অনেক দল সরকার গঠনে অংশ নেয়, যা কখনো অস্থিরতা তৈরি করে। স্থানীয় প্রতিনিধিত্ব দুর্বল হয়। জনগণ কেবল দল বেছে নেওয়ার সুযোগ পায়, নিদিষ্ট প্রার্থী নয়।
অন্যদিকে এমএমপিআরে একাংশ এফপিটিপি এবং একাংশ পিআর পদ্ধতিতে প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারে। এর সুবিধা হলো-স্থানীয় প্রতিনিধিত্ব বজায় থাকে (এফপিটিপি অংশ)। ভোটের ন্যায্য প্রতিফলন ঘটে (পিআর অংশ)। ছোট দলগুলোর অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। অধিকাংশ ভোট “ব্যথ” হয় না, বরং প্রায় সফল ভোটই কার্যকর থাকে। জনগণের পছন্দ আরও বেশি প্রতিফলিত হয়।
অসুবিধা হলো-কখনো সরকার গঠনে সময় লাগে, বিশেষ করে যদি জোটের প্রয়োজন হয়।
আলোচনায় অংশ নিয়ে এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, কোন না কোন ফর্মে পিআর কার্যকর করতে হবে।প্রাথমিকভাবে ২০০ আসন বিদ্যমান পদ্ধতিতে থাক, বাকি ১০০ আসনে জনমতের ভিত্তিতে পিআর পদ্ধতিতে যেতে পারি কিনা দেখতে হবে। মিক্সড পদ্ধতি চালু হোক। এতে ভোট নষ্ট হবে না। তিনি আরও বলেন, যে কারণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, জাতীয় পার্টিকে কেন নিষিদ্ধ করা হবে না?
ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, ইসলামী আন্দোলন ২০০৮ থেকে পিআর পদ্ধতির আলোচনা করে আসছে।
বিশ্বের ৫৪ টি দেশে এটি চালু আছে। কোন দল এটি না বুঝলে তাদের অজ্ঞতা। তাই বলে এই পদ্ধতি নিয়ে বিদ্রুপ করার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, যারা পিআরের বিরোধীতা করছে, তারা তাদের স্বার্থ দেখছে। তাহলে অন্যদের দাবিকে কেন নেগেটিভভাবে দেখা হচ্ছে। মিক্সড পদ্ধতি নিয়েও আলোচনা হতে পারে। কিন্তু নেগেটিভ মন্তব্য করার সুযোগ নেই। দুর্বলতাগুলো কিভাবে কাটানো যায় তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বড় কথা হলো- নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার করতেই হবে।
রাজনীতি বিশ্লেষক ড. ফয়জুল হক বলেন, বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিতে আলেমরা বঞ্চিত হচ্ছেন। এটাতে থাকলে যতই জোট করেন বেশি আসন পাবেন না। আরও গোলামী করে যেতে হবে। পিআর হলে অনেক বেশি আসন পাবেন। তিনি বলেন, কোনভাবেই ফ্যাসিবাদকে ফেরার সুযোগ দেয়া যাবে না। যারাই আওয়ামীলীগের প্রতি সহানুভূতি দেখাবে, তারাই দেশ এবং গণঅভ্যুত্থানের শত্রু।
ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী বলেন, পিআর যৌক্তিক। মিক্সড পদ্ধতি আরও যৌক্তিক মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদ যাতে কোনভাবে ফিরে না আসে, সেজন্য সবাইকে ঐকমত্য থাকতে হবে।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, আমরা নতুন ব্যবস্থা চাই। পুরানো ব্যবস্থায় থাকা খুব দুঃখজনক। আমরা আশ্চর্য হচ্ছি-অনেক সিনিয়র রাজনীতিবিদরা বলছেন, বড় দলের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না। তাহলে এই অভ্যুত্থান কি কোন দলের কথায় হয়েছে? অন্যদের প্রস্তাব ইগনোর করা যাবে না। তিনি বলেন, নির্বাচনে আপার পদ্ধতি অথবা মিক্সড পদ্ধতিতে যেতে পারি। তবে সংস্কার বিষয়ে সবার একমত হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক ড. আহমদ আবদুল কাদের বলেন, ৪০ টি দেশে পুরোপুরি পিআর পদ্ধতি আছে। কিছু দেশে মিক্সড পদ্ধতি আছে। যারা বলছেন, পিআর বুঝেন না, এটা তাদের অজ্ঞতা। মিক্সড পদ্ধতির পিআর চালু হতে পারে বলেও মত দেন তিনি।
গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা ইউসুফ আশরাফ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী, ইসলামী আন্দোলনের প্রেসডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইজহার, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস নেতা আতাউল্লাহ আমীন, মাওলানা তোফাজ্জল হোসেন মিয়াজী, মাওলানা শরাফত হোসেন, খেলাফত আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা সুলতান মহিউদ্দিন, ঢাবির সহযোগী অধ্যাপক আরিফুল ইসলাম অপু প্রমুখ।