বহু মুসলমান ভাইয়ের অবস্থা এমন যে আমল ও ইবাদতের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। নামাজ পড়তে ইচ্ছে করে না, ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ হয় না। অথবা নিয়মিত ইবাদত করা সম্ভব হয় না। এসব কিছু ঈমানি দুর্বলতার পরিচায়ক। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে ঈমানি দুর্বলতা কাটানোর ১০টি আমল বর্ণনা করা হলো-
১. এমন লোকদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলুন, যাঁদের সংস্পর্শে গেলে আমল বেড়ে যায়। যাঁরা অন্যকে আমলের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা, আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো। ’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১১৯)
২. বেশি পরিমাণে কোরআন তিলাওয়াত করুন বা শ্রবণ করুন। এ মর্মে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘…আর যখন তাদের সামনে তাঁর (আল্লাহর) আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তাদের ইমান বেড়ে যায়…। ’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ২)
৩. নবীদের সিরাত, সাহাবায়ে কেরামের জীবনী পড়ুন। কেননা মহান আল্লাহ মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের অন্তর প্রশান্ত করার জন্য পবিত্র কোরআনে নবীদের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। আর তিনি সাহাবায়ে কেরামের ঈমানকে আমাদের ঈমানের জন্য আদর্শ বানিয়েছেন। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন,..মানুষ যেভাবে ইমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ইমান আনো…। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৩) এ আয়াতের তাফসিরে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মুহাম্মদ (সা.)-এর সাহাবারা যেভাবে ইমান এনেছে, তোমরাও সেভাবে ইমান আনো। ’ (তাফসিরে তাবারি, সংশ্লিষ্ট আয়াত)
৪. অধিক হারে আল্লাহর জিকির করুন। কেননা দুর্বল ঈমানের সুস্থতার জন্য জিকির খুবই উপকারী। আল্লাহর জিকির অন্তরে ঈমানের বীজ বপন করে। মুমিনের অন্তর জিকিরের মাধ্যমে প্রশান্ত হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা ঈমানদার এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে। জেনে রেখো, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়। ’ (সুরা : রাদ, আয়াত : ২৮)
৫. ইসলামের সৌন্দর্য সম্পর্কে জানুন। কেননা ইসলামের সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য যুগে যুগে মানুষকে মুগ্ধ করেছে এবং ঈমানের প্রতি ধাবিত করেছে। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘…কিন্তু আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ঈমানের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং তা হৃদয়গ্রাহী করে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে কুফর, পাপাচার ও নাফরমানির প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এরাই সৎপথ অবলম্বনকারী। ’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ৭)
৬. প্রকৃতিতে আল্লাহর নিদর্শনগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করুন। আকাশে মেঘ দেখলে আরবরা খুশি হতো। কিন্তু মহানবী (সা.)-এর চেহারা আজাবের ভয়ে মলিন হয়ে যেত। কেননা সামুদ জাঁতি আজাব বহনকারী মেঘ দেখে রহমতের বৃষ্টি ভেবে ফুর্তিতে মেতেছিল। (মুসলিম, হাদিস : ৮৯৯)আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আসমান ও জমিন সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্য। ’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৯০)
৭. সব কিছুর চেয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে প্রাধান্য দিন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকবে সে ঈমানের মিষ্টতা পাবে; ১. যে কাউকে ভালোবাসলে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই ভালোবাসবে; ২. আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল তার কাছে অন্য সব কিছুর চেয়ে বেশি প্রিয় হবে এবং ৩. আল্লাহ তাকে কুফর থেকে পরিত্রাণ করার পর পুনরায় কুফরিতে ফিরে যাওয়ার চেয়ে অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হওয়া তার কাছে পছন্দনীয় হবে। ’ (বুখারি, হাদিস : ৪৯৮৭)
৮. আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার সামান্যতার কথা চিন্তা করুন। এর দ্বারা ইমান বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘পার্থিব জীবনের উদাহরণ তেমন, যেমন আমি আসমান থেকে পানি বর্ষণ করলাম, পরে তা মিলিত সংমিশ্রিত হয়ে তা থেকে জমিনের শ্যামল উদ্ভিদ বেরিয়ে এলো, যা মানুষ ও জীবজন্তুরা খেয়ে থাকে। এমনকি জমিন যখন সৌন্দর্য সুষমায় ভরে উঠল আর জমিনের অধিকর্তারা ভাবতে লাগল যে তারা এগুলোর ওপর ক্ষমতাবান। হঠাৎ করে তার ওপর আমার নির্দেশ এলো রাতে কিংবা দিনে, তখন সেগুলোকে কেটে স্তূপাকার করে দিল, যেন কালও এখানে কোনো আবাদ ছিল না। এমনিভাবে আমি চিন্তাশীল সমপ্রদায়ের জন্য নিদর্শনসমূহ খোলাখুলি বর্ণনা করে থাকি। ’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ২৪)
৯. আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা ঠিক রাখুন। অর্থাৎ বন্ধুত্ব ও শত্রুতা উভয়টিই আল্লাহর জন্য। সুতরাং মুমিনদের সঙ্গে সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব রাখুন। আর অবিশ্বাসীদের সঙ্গে সম্পর্কছেদ করুন। কেননা দ্বিনের শত্রুদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে ইমান দুর্বল হয়ে পড়ে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিঃসন্দেহে তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল এবং ঈমানদাররা, যারা নামাজ কায়েম করে, জাকাত আদায় করে এবং তারা বিনম্র। ’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৫৫)
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে, আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে, আল্লাহর জন্য প্রদান করে এবং আল্লাহর জন্য প্রদান থেকে বিরত থাকে, সে ইমান পরিপূর্ণ করেছে। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৬৮১)
১০. ঈমানি দুর্বলতার চিকিৎসায় বিনয় ও লজ্জাশীলতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ এটি আল্লাহভীতির সূচক। লজ্জা ঈমানের অঙ্গ। আবু মাসউদ বদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই মানুষ আগের নবীদের বাণী থেকে এ কথা জেনেছে যে যখন তোমার লজ্জা নেই তখন তুমি যা ইচ্ছে তা-ই করো। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৭৬৯) ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, এই হাদিসের ব্যাখ্যা দুইভাবে করা যায়-এক. কাজ ও তার নির্ধারিত ফলাফলবিষয়ক। অর্থাৎ যার লজ্জা নেই সে যা ইচ্ছে করতে পারে। দুই. তা সীমা ও অনুমোদনসংক্রান্ত আদেশ। অর্থাৎ যে কাজ তুমি করতে ইচ্ছে পোষণ করছ, সেদিকে খেয়াল করো, যদি তা লজ্জাজনক না হয় তবে তা করো। তবে মতটি সঠিক এবং বেশির ভাগের মত। তবে জ্ঞানার্জনে লজ্জা নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) জ্ঞানান্বেষণে লজ্জা না করায় আনসারি নারীদের প্রশংসা করে বলেন, ‘আনসারি নারীরা কতই না উত্তম! লজ্জা কখনো তাদের ধর্মের বিষয়ে জ্ঞানান্বেষণে বিরত রাখতে পারে না। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৭৭২) অনুরূপ সত্য কথা বলা বা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে লজ্জা নেই। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘…কিন্তু আল্লাহ সত্য বলতে লজ্জাবোধ করেন না…। ’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৫৩) মহান আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন।
সূত্র: এফএনএস