মাদারীপুরের শিবচরে থমকে গেছে তাঁতপল্লি নিয়ে ১৯শ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের কাজ। ভেঙে পড়ছে এর সীমানাপ্রাচীর, নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান সামগ্রী। অধিগ্রহণ করা ভূমি মালিকরা অনেকেই ক্ষতিপূরণ পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে।
পদ্মা সেতুসংলগ্ন শিবচরের কুতুবপুর ও শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবা এলাকায় ‘শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি’ নামে এ প্রকল্পের কাজ হাতে নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। প্রকল্পটির জন্য ১২০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। সম্প্রতি সরকার পতনের পর প্রকল্পের মালপত্র সরিয়ে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের মাদারীপুর অংশের পশ্চিম পাশের সীমানাপ্রাচীরের ৩শ ফুটের বেশি ভেঙে গেছে। ক্ষতিপূরণের টাকা এখনও না পাওয়ায় আক্ষেপ রয়েছে অনেক ভুক্তভোগীর। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, প্রকল্প বন্ধের কোনো তথ্য নেই তাদের কাছে। তবে ভুক্তভোগীরা ক্ষতিপূরণ পাবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন তারা।
জানা যায়, ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এর মোট ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এখানে আট হাজার ৬৪টি তাঁতশেড নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। আট হাজার ৬৪ জন তাঁতিকে পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে বছরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় প্রায় ৪ দশমিক ৩১ কোটি মিটার কাপড়। কয়েকটি ছয়তলা বিশিষ্ট ভবন, প্রত্যেক তাঁতির জন্য ছয়শ ফুটের কারখানা ও আটশ ফুটের আবাসন সুবিধাও ছিল। সরকারের পক্ষ থেকে সুতা, রংসহ কাঁচামালের সুবিধা, আন্তর্জাতিক মানের শোরুম, প্রশিক্ষণকেন্দ্র, তাঁতিদের ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সও ছিল প্রকল্প-পরিকল্পনায়। প্রকল্পটি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তি ক্ষতিপূরণের আশায় নতুন করে শত শত ঘরবাড়িসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ ও গাছপালা রোপণ শুরু হয়। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় পড়েনি এমন জমিতে থাকা ঘরবাড়িও ক্ষতিপূরণের আশায় ভেঙে ফেলা হয়। পরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভায় তৎকালীন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নেন, যারা অবৈধভাবে ঘরবাড়ি, গাছপালাসহ স্থাপনা নির্মাণ করেছিলেন তারা ক্ষতিপূরণের আওতায় পড়বেন না। পরে কিছুদিনের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় জমির প্রকৃত কিছু মালিক তাদের ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হন; যা এখনও পাননি তারা। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রকল্পের মধ্যে থাকা বিভিন্ন ধরনের নির্মাণসামগ্রী সরিয়ে নিয়ে যায় কর্তৃপক্ষ।
আজ মঙ্গলবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রকল্পের পশ্চিম দিকের সীমানা প্রাচীরের ৩শ ফুটের বেশি অংশ ভেঙে পড়ে আছে। মূল্যবান জিনিসপত্র নষ্ট হচ্ছে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, কাজের মান খারাপ ছিল বলে সীমানাপ্রাচীরের ওই অংশ ভেঙে পড়েছে। বাকি যে সরকারি সম্পত্তি আছে তা রক্ষণাবেক্ষণ না করলে সরকারের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হবে। প্রকল্প বন্ধ হলে শত শত কোটি টাকা গচ্চা যাবে- বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় বাসিন্দা সোহেল খান বলেন, প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর যে জায়গাটিতে হয়েছে ঠিক সে জায়গাটিতে তাঁর ঘর ছিল। ঘর ছিল তাঁর বংশের অনেকের। অথচ ক্ষতিপূরণ পাননি তারা। এখনও ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে ধরনা দিতে হয়। অনেকে ক্ষতিপূরণ পেতে ঘুষ দিয়েছেন। ঘুষ দেননি বলে তাঁরা ক্ষতিপূরণ এখনও পাননি বলে অভিযোগ করেন তিনি।
স্থানীয়রা জানায়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখা ও দালালদের ঘুষ না দিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা তুলতে পারেননি অনেকেই। এখনও অনেকে ক্ষতিপূরণ পাননি। সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণের দাবি জানান তারা। এছাড়া একটি সড়ক ছিল, যা প্রকল্পের মাঝ দিয়ে গেছে, সেটিও বন্ধ করা হয়েছে। সড়কটি চালু হলে কয়েক হাজার মানুষের সুবিধা হয়।
মাদারীপুর সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ পারভেজ বলেন, যারা ক্ষতিপূরণ পাননি তারা সেটি পাওয়ার অধিকার রাখেন। তাদের ক্ষতিপূরণের টাকা দ্রুত দিয়ে দেওয়া দরকার। প্রকল্পটির কাজ বন্ধ করলে সরকারের শত শত কোটি টাকা ক্ষতি হবে। সঠিক তদারকির মাধ্যমে কাজটি শুরু করলে ভালো হয়।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মোছা. ইয়াসমিন আক্তার বলেন, কাগজপত্র যাচাই করে ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়েছে। যদি কেউ না পেয়ে থাকেন তাদের অবশ্যই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। প্রকল্পের কাজ চলা না চলার বিষয়ে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসনের কাছে তেমন কোনো তথ্য নেই।
সূত্র: এফএনএস