দস্যি শিশুটি লাট্টুর মতো বনবন করে ঘুরে চলেছে ভয়ঙ্কর গতিতে। আমাদের থেকে মাত্র ১৬ হাজার আলোকবর্ষ দূরে (আলো যে দূরত্ব পাড়ি দেয় ১৬ হাজার বছরে)। ‘স্যাজিটারিয়াস’ নক্ষত্রপুঞ্জে।
১৬ হাজার বছর আগে তার থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা আলো তাকে আমাদের নজরে এনেছে মাসতিনেক আগে। গত ১২ মার্চ। ১৬ হাজার বছর বলতে এখানে কিন্তু দূরত্ব বোঝানো হচ্ছে। সময় নয়। এত দিনে তা আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে বলেই নাসার ‘নিল গেহ্রেল্স সুইফ্ট অবজারভেটরি’র নজরে পড়েছে। মহাজাগতিক শিশুটির হদিশ মেলার খবর বেরিয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটার্স’-এ। এই নবজাতকের নাম রাখা হয়েছে, ‘সুইফ্ট-জে১৮১৮.০-১৬০৭’।
দেড় সেকেন্ড অন্তর উগরে দিচ্ছে আলো
লাট্টুর মতো বনবন করে ঘুরতে ঘুরতে এই দস্যি শিশু উগরে দিচ্ছে আলো। যদিও তা আমাদের দৃশ্যমান আলো নয়। আলোকতরঙ্গেরই আরও দু’টি রশ্মি। দুর্বলতম রেডিও ওয়েভ। আর তার তুলনায় শক্তিশালী এক্স-রে। ঝলকে ঝলকে (‘পাল্স’)। ১.৩৬ সেকেন্ড অন্তর। সেই আলো বেরিয়ে আসছে ‘লাইটহাউস’ বা বাতিঘরের মতো। যেহেতু এই সুপারপাওয়ার আদতে একটি প্রকাণ্ড চুম্বক, তাই তার অক্ষ ধরে দু’টি দিকে বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ছে মহাকাশে। বাতিঘরের আলোর মতোই ঘুরতে ঘুরতে তা আমাদের সামনে এলে তাকে দেখতে পাচ্ছি, না এলে দেখতে পাচ্ছি না। সেই আলোই আমাদের নজরে এনেছে এই দস্যি শিশুকে। যে উগরে দিচ্ছে একই সঙ্গে একটি কণা আর তার প্রতিরূপও। ইলেকট্রন আর পজিট্রন। ব্রহ্মাণ্ডে এমন ঘটনার এক অত্যাশ্চর্য গবেষণাগার এই সুপারপাওয়ার শিশু।
চেহারায় ‘কলকাতা’, শক্তি আমাদের সেরা চুম্বকের ১০ হাজার কোটি গুণ!
এর আয়তন সূর্যের আয়তনের এক লক্ষ কোটি ভাগেরও এক ভাগ হলে হবে কি, এর ভর কিন্তু সূর্যের দ্বিগুণ! তবে চেহারাটা বড়জোর কলকাতা শহরের মতো।
এই নবজাতক আসলে একটি বিরল জাতের নিউট্রন নক্ষত্র। অসম্ভব শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের জন্য যাদের বলা হয় ‘ম্যাগনেটার’। ম্যাগনেট (চুম্বক) আর স্টার (নক্ষত্র) শব্দদু’টি জুড়েই এই নাম। নিউট্রন নক্ষত্রদের বয়স সাধারণত ১০ কোটি বছর বা তারও বেশি হয়। কিন্তু ম্যাগনেটারদের বয়স কয়েক হাজারের বছরের মতো হয়।
আমরা পৃথিবীতে এত দিনে যতটা শক্তিশালী চুম্বক বানাতে পেরেছি (জাপানে), এই নবজাতকের চৌম্বক ক্ষেত্র তার চেয়ে ১০ হাজার কোটি গুণ শক্তিশালী। গড়পড়তা নিউট্রন নক্ষত্রের চেয়ে এর চৌম্বক ক্ষেত্র ১০০০ গুণ শক্তিশালী। ব্রহ্মাণ্ডে এদের থেকে শক্তিশালী চুম্বক আর কিছু হতে পারে না। তাই এদের আরও একটি নাম- ‘ম্যাগনেটিক সুপারপাওয়ার’।
ম্যাগনেটার তৈরি হয় কী ভাবে? দেখুন ভিডিয়ো
সে জন্যই এরা পড়ে মহাজাগতিক বস্তুদের মধ্যে একটি বিরলতম শ্রেণিতে। যাদের ম্যাগনেটার বলা হয়। এখনও পর্যন্ত ৩ হাজারেরও বেশি নিউট্রন নক্ষত্রের খোঁজ মিলেছে। এই নবজাতককে নিয়ে এমন সুপারপাওয়ারের হদিশ ৩১টির বেশি মেলেনি এখনও পর্যন্ত!
জন্ম পলাশির যুদ্ধেরও আড়াই দশক পর!
এদের মধ্যে এই নবজাতকের বয়সই সবচেয়ে কম। গবেষকরা বলেছেন, যখন প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলেন জর্জ ওয়াশিংটন, তখনই জন্ম হয় এই শিশুর। তার কিছু দিন আগেই ভারতে পলাশির যুদ্ধটা হয়েছিল। নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার মৃত্যু হয়েছিল।
এর অর্থ, পলাশির যুদ্ধের আড়াই দশক পরেই আমরা এই ম্যাগনেটারের জন্ম-মুহূর্তের ঘটনাবলী পৃথিবী থেকে দেখতে পেতাম।
অন্য ম্যাগনেটারগুলির তুলনায় এই শিশুটি রয়েছেও আমাদের সবচেয়ে কাছে। এর আগে সবচেয়ে কম বয়সের যে নিউট্রন নক্ষত্রের হদিশ মিলেছিল তার নাম- ‘পিএসআর-জে১৮৪৬-০২৫৮’। তার বয়স এখন ৭৩০ বছর।
কী ভাবে জন্মায় এরা?
মৃত্যুদশায় পৌঁছলে কোনও তারা বা নক্ষত্রের ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ হয়। যাকে বলা হয়, ‘সুপারনোভা’। সেই বিস্ফোরণের সময় নক্ষত্রের ভিতরে থাকা পারমাণবিক জ্বালানি খুব দ্রুত জ্বলতে শুরু করে। তার ফলে, সৃষ্টি হয় এক ধরনের বলের (‘ফোর্স’)। যা নক্ষত্রটিকে ফুলিয়ে তুলতে চায়। কিন্তু পারে না। নক্ষত্রের নিজস্ব অভিকর্ষ বলের পাল্টা চাপে। যা নক্ষত্রটিকে চুপ্সে দিতে চায়।
কিন্তু তার পারমাণবিক জ্বালানি যখন শেষ হয়ে আসে, তখন গায়ের জোর বেড়ে যায় অভিকর্ষ বলের। তার টানে নক্ষত্রের সবটুকু ভর কেন্দ্রীভূত হতে শুরু করে। সেই সময়েই ঘটে ফের বিস্ফোরণ। যা থেকে জন্ম হয় নিউট্রন নক্ষত্র আর শ্বেত বামন নক্ষত্রদের (‘হোয়াইট ডোয়ার্ফ’)। জন্ম হয় ‘ব্ল্যাক হোল’ বা কৃষ্ণগহ্বরেরও।
যে নক্ষত্রটি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তার ভর যদি সূর্যের ভরের ১০ থেকে ২০ গুণের মধ্যে হয় তা হলে সুপারনোভার পর জন্ম নেবে নিউট্রন নক্ষত্র। ভর যদি ২০ গুণের বেশি হয় তা হলে তৈরি হবে ব্ল্যাক হোল। আর সেই নক্ষত্রের ভর যদি সূর্যের ভরের ৫ থেকে ১০ গুণের মধ্যে হয়, তা হলে সেই তারাটি পরিণত হবে শ্বেত বামন নক্ষত্রে। তারা নয়, যেন ‘তারার ভূত’!
ভূতের কথা ছেড়ে ভবিষ্যতের কথায় আসি। সুপারনোভার পর কোনও নক্ষত্রের ভবিতব্য বলতে মূলত দু’টি। নিউট্রন নক্ষত্র অথবা ব্ল্যাক হোল। ব্ল্যাক হোলের অভিকর্ষ বল এতটাই জোরালো, আলোও তার নাগপাশ কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে না। তাই সে এতই কালো যে, তাকে দেখাও যায় না। ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে সে মহাকাশে। কণা, পদার্থ, আলো, এই ব্রহ্মাণ্ডে যা কিছুই তার নাগালে আসে, তাকেই রাক্ষসের মতো গিলে খায় ব্ল্যাক হোল। তার ভয়ঙ্কর ক্ষুধা থেকে কারও রেহাই মেলে না।
অভিকর্ষ বল নিউট্রন নক্ষত্রেরও থাকে। কিন্তু তাকে অস্বীকার করার শক্তি থাকে নিউট্রন নক্ষত্রের মধ্যেই। যা শুধুমাত্র গড়া পরমাণুর কেন্দ্রে থাকা ‘শ্রীনিরপেক্ষ’ কণা নিউট্রন দিয়ে। এই নিউট্রনগুলিই অভিকর্ষ বলকে অস্বীকার করার শক্তি জোগায় নিউট্রন নক্ষত্রকে। তাই নিউট্রন নক্ষত্র তার চেহারা ধরে রাখতে পারে। অভিকর্ষ বলের টানে চুপ্সে যায় না।
পৃথিবীর অভিকর্ষ বলকে অস্বীকার করে যেমন আমাদের এই গ্রহকে গোলকের মতো ফুলিয়ে রাখে ইলেকট্রন কণারা।
এই নিউট্রন নক্ষত্রগুলিই ব্রহ্মাণ্ডে সোনা, রুপো, প্ল্যাটিনামের মতো বহু মূল্যবান ভারী মৌলের আঁতুড়ঘর। আমাদের পৃথিবীতেও এরা এসেছে এই একই আঁতুড়ঘর থেকে।
ব্রহ্মাণ্ডের নিরিখে নিউট্রন নক্ষত্রগুলি আকারে নস্যিই! বড়জোর কলকাতার মতো একটা শহর। ব্যাস খুব বেশি হলে হয় ১০ থেকে ২০ মাইল (বা ১৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার)-এর মধ্যে।
তবে এদের ঘনত্ব হয় অসম্ভব বেশি। ব্ল্যাক হোলের পর ঘনত্বের বিচারে এদের হারানোর মতো আর কেউ নেই এই ব্রহ্মাণ্ডে। এদের মধ্যে থাকা কণাগুলিকে (মূলত, নিউট্রন) একটা চামচেতে নিলে পৃথিবীতে তার ওজন হবে ৪০০ কোটি টন!
আমরা যে ভাবে সময় আর দূরত্ব মাপি, জ্যোতির্বিজ্ঞানে তা করা যায় না। সেখানে ব্যবহার করা হয় ‘অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল স্কেল’। জ্যোতির্বিজ্ঞানের মাপকাঠি। মানদণ্ডও বলা যায়। যেখানে সময়ের হিসাব হয় কোটি কোটি বছরে। আর দূরত্ব মাপা হয় আলোকবর্ষে। এক বছরে আলো যতটা দূরত্বে পাড়ি জমাতে পারে, সেই নিরিখে। মানে, লক্ষ কোটি কিলোমিটার। এক আলোকবর্ষ বলতে বোঝায়, ৯.৪৬ লক্ষ কোটি কিলোমিটার বা প্রায় ১০ লক্ষ কোটি কিলোমিটার। এই বিশেষ ধরনের নিউট্রন নক্ষত্রের বয়স মাত্র ২৪০ বছর বলে জানা গিয়েছে। তাই গবেষকদের দাবি, জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় এটি সদ্যোজাত শিশুই।
কেন এই আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ?
নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরির (জেপিএল) সিনিয়র সায়েন্টিস্ট গৌতম চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, এর চৌম্বক ক্ষেত্র অত্যন্ত শক্তিশালী। গড়পড়তা নিউট্রন নক্ষত্রগুলির চৌম্বক ক্ষেত্রের ১ হাজার গুণ বেশি। এ জন্যই এদের বলা হয় ম্যাগনেটার। ব্রহ্মাণ্ডে এদের চেয়ে শক্তিশালী চুম্বকের হদিশ মেলেনি। ব্রহ্মাণ্ডে এরা আক্ষরিক অর্থেই, সুপারডুপার পাওয়ার। যেটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হল, এমন ধরনের নিউট্রন নক্ষত্রের জীবনের একেবারে প্রথম মুহূর্তগুলির খবরাখবর এর আগে আমরা পাইনি। এর আলো রওনা দিয়েছিল ১৬ হাজার বছর আগে, যখন তার বয়স ছিল ২৪০ বছর। সেই আলোটাই এখন এসে পৌঁছছে।
গৌতমের কথায়, “হয়তো এ বার আমাদের বুঝতে সুবিধা হবে, কী ভাবে জন্ম হয় এই অসম্ভব শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের ম্যাগনেটারদের। এর আগে আমরা যে ম্যাগনেটারগুলির হদিশ পেয়েছি, তাদের বয়স অনেক বেশি। বয়স বেশি হয়ে গেলে তারা কী ভাবে জন্মেছিল, তা বোঝা সম্ভব হয় না। তাই এই আবিষ্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’’
এই শিশুকে বিকিরণের শক্তি জোগাচ্ছে কে?
সাধারণত, যে কোনও চুম্বকই যদি তার চার দিকে বনবন করে ঘোরে, তা হলে তার আবেশে একটি বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র (ইলেক্ট্রিক ফিল্ড) তৈরি হয় তার চার পাশে। এই বৈদ্যুতিক আর চুম্বকের নিজস্ব চৌম্বক ক্ষেত্র মিলেই জন্ম দেয় কণা ও শক্তির। যা বেরিয়ে আসে বিকিরণের মাধ্যমে। চুম্বকের এই ধর্মকে কাজে লাগিয়ে এক সময় বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের কথা ভেবেছিল মানুষ। কিন্তু তা করা যায়নি। দেখা গিয়েছিল, তার জন্য প্রকাণ্ড চুম্বককে ঘোরাতে অনেক বেশি শক্তি খরচ করতে হবে। তুলনায় বিদ্যুৎশক্তির উৎপাদন ততটা হবে না।
বনবন করে ঘোরা সাধারণ চুম্বকের মতো নিউট্রন নক্ষত্র থেকেও বিকিরণ বেরিয়ে আসে। সেগুলি যেমন আলোকতরঙ্গের মধ্যে দুর্বলতম রেডিও ওয়েভ বিকিরণ করতে পারে, তেমনই তা বিকিরণ করে সবচেয়ে শক্তিশালী গামা রশ্মি বা তুলনায় দুর্বল এক্স রশ্মি। সেগুলির মধ্যে যেগুলি পৃথিবীর দিকে আসে, সেগুলিই আমাদের নজরে পড়ে। বাতিঘরের আলোর মতো। তাই এগুলিকে বলা হয় ‘পালসার’।
পালসার প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯৬৭ সালে। আবিষ্কারটি নোবেল পুরস্কার পায়।
নিউট্রন নক্ষত্রদের মধ্যে এই বিশেষ জাতের ম্যাগনেটারদের চৌম্বক ক্ষেত্র অনেক অনেক গুণ বেশি শক্তিশালী হয় বলে তাদের থেকে শক্তির বিকিরণ আরও বেশি হয়। বিকিরণটা একটানা হয় না। তা বেরিয়ে আসে ঝলকে ঝলকে। যেন এক একটা ‘পাল্স’।
গড়পড়তা পালসার যেমন তার ঘূর্ণনের শক্তিতে বিকিরণ দেয়, বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ম্যাগনেটারদের ক্ষেত্রে সেটা হয় না। ম্যাগনেটারদের বিকিরণের জন্ম হয় তাদের চৌম্বক ক্ষেত্রের মোচড় মারা থেকে। এটাই নিউট্রন নক্ষত্রদের থেকে আলাদা করে দেয় ম্যাগনেটারদের।
যে প্রশ্নগুলির জবাব মেলেনি
এই নবজাতকের থেকে কিন্তু এখনও পর্যন্ত দু’ধরনের বিকিরণ দেখা গিয়েছে। এক্স রশ্মি আর রেডিও ওয়েভ। সেগুলিই পৃথিবীর দিকে এসেছে বলে। কিন্তু গামা রশ্মি দেখা যায়নি এখনও। বিজ্ঞানীদের প্রশ্ন, যদি নবজাতকই হয়, তা হলে কেন আলোকতরঙ্গের সবচেয়ে শক্তিশালী গামা রশ্মির বিকিরণ দেখা যায়নি এই ‘সদ্যোজাত’-এর থেকে? নাকি সেই ধরনের রশ্মিও ঠিকরে বেরিয়েছে, কিন্তু পৃথিবীর দিকে আসেনি বলে তা নজরে পড়েনি? এও প্রশ্ন, ‘সদ্যোজাত’ই যদি হবে, তা হলে কেন তার থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা এক্স রশ্মির তীব্রতা আরও বেশি হল না? কেন তার থেকে বেরিয়ে আসা এক্স রশ্মি অনেকটাই মিনমিনে?
অসম্ভব গতিতে নিজের চার দিকে লাট্টুর মতো বনবন করে ঘোরে বলেই বিপুল পরিমাণ শক্তি বিকিরণ করতে পারে এই ম্যাগনেটাররা। যত সময় গড়ায়, ততই ঘূর্ণনের গতি কমতে থাকে এদের। কমে আসতে থাকে তাদের থেকে বেরিয়ে আসা বিকিরণের তীব্রতাও।
এদের বয়স মাপা হয় কী ভাবে?
‘টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর)’-এর অধীনে থাকা পুণের ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি (এনসিআরএ)’-র অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর দীপাঞ্জন মিত্র বলছেন, “পালসারগুলি (এখানে নবজাতকের মতো ম্যাগনেটারগুলি) থেকে ঠিকরে বেরনো বিকিরণ খুব নিয়ম মেনে হয়। নির্দিষ্ট সময় অন্তর। একেবারে পারমাণবিক ঘড়ির সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে। এতটাই নিখুঁত। ফলে, এক পাক ঘূর্ণনের জন্য তার কতটা সময় লাগছে, তা নিখুঁত ভাবে মাপা যায়। শক্তির বিকিরণ করতে করতে তাদের সেই ঘূর্ণনের গতি কমে এলে ঘূর্ণনের সময়টা (স্পিন পিরিয়ড) বেড়ে যায়। সেটাও মাপা যায় নিখুঁত ভাবেই। ঘূর্ণনের সময় আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ঘূর্ণনের গতি কী ভাবে কমে আসছে, তার অনুপাত থেকেই বয়স মাপা হয় ম্যাগনেটারদের। মাপা যায়, আমাদের নজরে আসার সময় তার চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তি কতটা।’’
সত্যি সত্যিই কি এদের বয়স এত কম?
পুণের ‘ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আয়ুকা)’-এর অধ্যাপক, ভারতের ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’ মিশনের সায়েন্স অপারেশন্স বিভাগের প্রধান দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের বক্তব্য, আরও পর্যবেক্ষণ করতে হবে এই ম্যাগনেটারটিকে, এ কথা গবেষকরাও বলেছেন। এটা ঠিকই, নাসার নিল গেহ্রেল্স সুইফ্ট অবজারভেটরির নজরে প্রথম আসার পর নাসার ‘নিউস্টার স্পেস অবজারভেটরি’ আর ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (‘ইসা’) এক্সএমএম ‘নিউটন স্পেস অবজারভেটরি’ও এটির উপর নজর রেখেছিল। কিন্তু সময়টা বড়ই অল্প। এটির প্রথম হদিশ মেলে ১২ মার্চ। তার পর সবে মাসতিনেক হয়েছে। এই পালসারগুলির ক্ষেত্রে এমন হঠাৎ হঠাৎ ঝলক দেখা যেতেই পারে। পরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার তীব্রতা কমে আসে। এর ক্ষেত্রেও তা হতে পারে।
দীপঙ্করের কথায়, “ম্যাগনেটারদের ক্ষেত্রে ঘূর্ণনের গতি কমে আসার হারে অনেক তারতম্য থাকে। কারও কম হয়, কারও বেশি। এমন পালসার বা ম্যাগনেটারদের সঠিক বয়স জানতে হলে তাই এদের উপর একটানা নজর রেখে যেতে হবে। দেখতে হবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিকিরণের তীব্রতা কতটা কমছে বা কমা-বাড়া করছে কি না। তবেই সঠিক বয়স বলা সম্ভব। তার জন্য আরও কিছুটা সময় প্রয়োজন। তা ছাড়াও, এই ম্যাগনেটারটির তাপমাত্রা ১০ লক্ষ ডিগ্রি কেলভিনেরও বেশি। এই তাপমাত্রায় তার থেকে যতটা শক্তিশালী এক্স রশ্মি বেরিয়ে আসার কথা, তা হয়নি। বরং দেখা গিয়েছে, এক্স রশ্মির বিকিরণ অনেকটাই দুর্বল। মাত্র ২৪০ বছর বয়স হলে এই ম্যাগনেটারের তাপমাত্রা যত বেশি হওয়া উচিত ছিল, তাপমাত্রা ততটা থাকলে তার থেকে বেরিয়ে আসা এক্স রশ্মি এতটা দুর্বল হয় কী ভাবে? তাই আমার মনে হয়, এর আদত বয়স আরও বেশি।’’
তাই দীপঙ্করের বক্তব্য, এখন দেখতে হবে, এর বয়স আরও বেশি কি না। বয়স বাড়লেই বিকিরণের তীব্রতা কমে যায় এদের। এ ছাড়াও এটি কনিষ্ঠতম মহাজাগতিক শিশু, এটাও বলা হয়তো উচিত হবে না। কারণ, এর আগে এর চেয়েও কম বয়সের মহাজাগতিক বস্তুর হদিশ মিলেছে। যার বয়স ছিল ১০০ বছর। সেটি ছিল ‘সুপারনোভা রেমন্যান্টস’। সুপারনোভার অবশেষ। টুকরোটাকরা।
দীপাঞ্জন জানাচ্ছেন, পালসারের ঘূর্ণনের সময় আর তার ঘূর্ণনের গতিবেগ কমার হার মেপেই পালসারদের বয়স মাপা হয়। ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে, ক্র্যাব সুপারনোভার বিস্ফোরণ দেখা গিয়েছিল ১০৫৪ সালে। আর এখনও আমরা সেই সুপারনোভার অবশেষ দেখতে পাই। সেই অবশেষের ঠিক কেন্দ্রস্থলে ক্র্যাব পালসারও পাওয়া গিয়েছে। যেহেতু পালসারের জন্ম সুপারনোভার সময়েই, তাই ২০২০ সালে সেই পালসারের বয়স আমরা নির্দিষ্ট করে বলতে পারি ৯৬৬ বছর। আবার এই পালসারের ঘূর্ণনের গতিবেগ ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার গতিবেগ কমার হার থেকে তার যে বয়স পাওয়া যায়, তা ক্র্যাব পালসারের এই নির্দিষ্ট বয়সের (৯৬৬ বছর) খুব কাছাকাছি। ফলে, পালসারের ঘূর্ণনের সময় আর তার ঘূর্ণনের গতিবেগ কমার হার মেপে পালসারদের বয়স মাপার মডেল ক্র্যাব পালসারের বয়স সঠিক ভাবে মাপার ক্ষেত্রে খুবই কার্যকরী হয়েছে। ঘটনা হল, সেই একই পদ্ধতিতে মাপা হয়েছে এই নবজাতকের বয়স। তাতে দেখা গিয়েছে, এই নবজাতকের বয়স মাত্র ২৪০ বছর।
তবে সেই ক্র্যাব পালসারের আশপাশে সুপারনোভার অবশেষেরও খোঁজ মিলেছিল। মহাকাশে সুপারনোভার অবশেষ বিলীন হয়ে যেতেও অনেকটা সময় লাগে। অন্তত ১০ হাজার বছর। সেই অবশেষ আশপাশে মিলেছিল বলেই ক্র্যাব পালসারকে ‘তরুণ’ বলা হয়।
কেন তার আশপাশে নেই নক্ষত্রের ধ্বংসাবশেষ?
দীপাঞ্জনের কথায়, “এই নবজাতকের আশপাশে কিন্তু এখনও পর্যন্ত সুপারনোভার অবশেষ মেলেনি। তাই এমন প্রশ্নও উঠতে পারে, সেই অবশেষ কি বিলীন হয়ে যাওয়ার পর্যাপ্ত সময় পেয়েছে এই নবজাতকটির ক্ষেত্রে? যদি তা-ই হয়, তা হলে এর বয়স এত কম বলা যাবে কি?’’
দীপাঞ্জন এও জানাচ্ছেন, এই ম্যাগনেটারটির আচার-আচরণও এর আগে আবিষ্কৃত পালসারগুলির মধ্যে দেখা যায়নি। এটা যেমন অন্য পালসারগুলির মতো ঘূর্ণনের শক্তি থেকে বিকিরণ করছে, তেমনই আবার ম্যাগনেটারগুলির মতো তার চৌম্বক ক্ষেত্রের মোচড় মারা থেকেও বিকিরণের জন্ম দিচ্ছে। এটা একেবারেই অন্য ধরনের ঘটনা। এটা কেন হচ্ছে, তা নিয়েও হয়তো গবেষণা শুরু হবে এ বার।
এই সুপারপাওয়ার শিশু যে এক দিন ব্রহ্মাণ্ডের অনেক জটিল রহস্যের জট খুলে দিতে পারে, তা মেনে নিতে আপত্তি নেই প্রায় কারও। সুত্র: আনন্দ বাজার