৫ বছরের প্রকল্প সাড়ে ৭ বছরেও শেষ না হওয়ায় ফেরত যাচ্ছে বরাদ্দের টাকা। সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পটি বিগত ২০১৮ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত পাঁচ বছরে শেষ হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিলো। কিন্তু ২০১৯ সালের মে মাসে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পটির জন্য ১ হাজার ৮৬৮ কোটি ৮৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিলো। তার মধ্যে বিশ্বব্যাংক ১ হাজার ৫৮৮ কোটি ৩৯ লাখ ৫ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকার ২৮০ কোটি ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ অনুমোদন করে। পরে ২০২৩ সালের জুনে নতুন করে প্রকল্পটির আড়াই বছর সময় বাড়ানো হয়। ওই মেয়াদও গত নভেম্বরে শেষ হয়। ফলে শর্ত অনুযায়ী প্রকল্পের বরাদ্দকৃত টাকার বড় অংশ দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের কাছে ফেরত যাচ্ছে। মৎস্য অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পটি যথাসময়ে শেষ করা গেলে পরবর্তী ৩০ বছর সামুদ্রিক মৎস্য খাত ও বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা সর্বোচ্চ ব্যবহারের সুযোগ লাভ করতো। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় বড় অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়াই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। আর ভূমি অধিগ্রহণ ব্যর্থতা, অনুমোদন জটিলতা ও ধীর অগ্রগতির কারণে সার্ভিল্যান্স চেকপোস্ট, পন্টুন, ল্যান্ডিং সেন্টার, ল্যাবরেটরি ও খাল পুনর্বাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণের বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হয়নি। ডিপিপি অনুযায়ী শতভাগ কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় অনেক কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। মূলত কভিড-১৯ মহামারীর কারণে প্রকল্পের কাজ স্থবির হয়ে পড়া এবং কয়েক দফায় প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনের কারণে কাজে অগ্রগতি হয়নি। আর নতুন পরিচালক নিয়োগের কারণে তার প্রকল্পটি বুঝতেই অনেক সময়ক্ষেপণ হয়েছে। যার প্রভাব প্রকল্পের অগ্রগতিতে পড়েছে। তাছাড়া প্রকল্পের শুরুর দিকে যেভাবে কাজটি করার কথা ছিল সেভাবে করা হয়নি। প্রকল্পের আওতায় সমুদ্র থেকে মৎস্য শিকার করে আনা জাহাজগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় আনতে ১৬টি জেলায় ১৮টি ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টারসহ (মাছের বাজার) নানা অবকাঠামো নির্মাণ করার পরিকল্পনা ছিল। ওসব অবকাঠামো নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ না করতে পারায় ছোট পরিসরে প্রকল্পের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ শেষ করা হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় মূলত প্রকল্পটির কাজ নতুন করে প্রায় আড়াই বছর বাড়ানো হয়। যেহেতু ডিপিপি অনুযায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি, সে কারণে প্রকল্পের কাজ সম্ভব নয় বলে বিশ্বব্যাংককে জানানো হয়। তাতে বিশ্বব্যাংক বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে এবং বরাদ্দকৃত টাকা ফেরত দিতে হচ্ছে।
সূত্র জানায়, প্রকল্পের বাস্তবায়ন এলাকা দেশের উপকূলীয় ১৬টি জেলার ৭৫টি উপজেলা এবং ৭৫০টি ইউনিয়নে নির্ধারণ করা হয়। ওই ১৬টি জেলার মধ্যে আছে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর, গোপালগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্ণীপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, বরগুনা, পিরোজপুর, পটুয়াখালী ও ভোলা। ওসব জেলায় প্রকল্পের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও উৎপাদন ব্যবস্থার আধুনিকায়নে অনেক পরিকল্পনা ডিপিপিতে থাকলেও জমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তার মধ্যে ১৬টি সার্ভিল্যান্স চেকপোস্ট ও ১৬টি ফিশারিজ পন্টুন স্থাপনের কথা থাকলেও বাস্তবে ৫টি চেকপোস্ট এবং ৬টি পন্টুন নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পে ১৮টি ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টার/হারবার জায়গায় তিনটি অবতরণ কেন্দ্র (লালমোহন সদর, ভোলা ও লক্ষ্ণীপুরের রামগতি) এবং দুটি মাছ বাজারের (কক্সবাজারের পেকুয়া ও বাগেরহাটের শরণখোলা) আধুনিকায়ন করা হয়েছে। তাছাড়া তিনটি ডায়াগনস্টিক ল্যাব, তিনটি পিসিআর ল্যাব এবং তিনটির বদলে পাঁচটি কোয়ারেন্টাইন ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু কোয়ারেন্টাইন রেফারেন্স ল্যাবটি বাস্তবায়ন করা যায়নি। তবে চিংড়ি উৎপাদন ব্যবস্থায় একটির স্থলে দুটি ব্রুড ম্যানেজমেন্ট সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া প্রকল্পে আওতায় সমুদ্রে মৎস্য আহরণকারী নৌযানগুলোর নিরাপত্তার জন্য ট্র্যাকিং সিস্টেম লাগানোর কথা থাকলেও প্রকল্পে সেভাবে কাজ করা হয়নি। বরং পরীক্ষামূলকভাবে দায়সারা কাজ করা হয়েছে। সমুদ্রে নিয়মিত মনিটারিং করার জন্য ১৬টি হাইস্পিড পেট্রল বোট কেনার কথা থাকলেও মাত্র ছয়টি কেনা হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে ৫০০ হেক্টরজুড়ে ১২৯টি খাল পুনর্বাসন ও খনন করার পরিকল্পনা থাকলেও সেভাবে তা বাস্তবায়ন হয়নি। আর অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রম প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে বাস্তবায়নের যেভাবে পরিকল্পনা ছিল, সেভাবে বাস্তবে জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রগুলোতে অগ্রগতি নেই।
সূত্র আরো জানায়, সমুদ্রে মাছ আহরণকারী নৌযানের নিবন্ধন শেষ হয়নি। তবে মোট ৩০ হাজার ২২১টি বোটের তালিকা তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে বাণিজ্যিক জাহাজ ২৬৪টি এবং ছোট নৌযান (আর্টিশনাল বোট) ২৯ হাজার ৯৫৭টি। এ পর্যন্ত ২৫ হাজার ২৬৯টি নৌযানের নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। ওসব নৌযানে মোট ২ লাখ ৭৩ হাজার ৮১৯ জন মানুষ কাজ করে। যদিও সমুদ্রে মৎস্য আহরণে আর্টিশনাল বোটের সংখ্যা ৬৮ থেকে ৭০ হাজার।
এদিকে প্রকল্পটিতে মোট বরাদ্দের ৪০ শতাংশেরও কম টাকা ব্যয় হয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণে দেরি, ঠিকাদারি কাজের ধীরগতি, অনুমোদন জটিলতা, জমি অধিগ্রহণ এবং জনবল সংকটের কারণে বরাদ্দের অর্থ ব্যয় হয়নি। আরো দেড় বছর পার হয়ে গেলেও বেশির ভাগ স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। যদিও প্রকল্প পরিচালকের অগ্রগতি প্রতিবেদন বলছে, প্রকল্পটিতে উল্লেখযোগ্য কাজের অগ্রগতির মধ্যে রয়েছে অবকাঠামো নির্মাণ, সামুদ্রিক মৎস্য জরিপ, গুরুত্বপূর্ণ মৎস্য মজুদ নিরূপণ, মৎস্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন, মেরিকালচার গবেষণা, সি-উইড চাষ ও বিভিন্ন মূল্য সংযোজন পণ্য উৎপাদন, রোগমুক্ত চিংড়ি উৎপাদনের জন্য ব্রুড ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র স্থাপন, চিংড়ি উৎপাদন বাড়ানো, হ্যাচারি ও নার্সারি উন্নয়ন, জেলে ও নৌযান নিবন্ধন ব্যবস্থা গড়ে তুলে ১৮ লাখ জেলের অন্তর্ভুক্তীকরণ এবং ৪৫০টি জেলে গ্রামের পরিবারগুলোর বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ, মডেল গ্রাম ও ক্ষুদ্র উদ্যোগ উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদন, সুরক্ষা, জীবনমান ইত্যাদি উন্নয়নে কাজ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক মো. জিয়া হায়দার চেনধুরী জানান, প্রকল্পটির কাজ ২০১৯ সালে শুরু হলেও আমি প্রায় দুই বছর আগে দায়িত্ব নিয়েছি। বর্ধিত সময়ের প্রকল্পের কাজ নভেম্বরেই শেষ হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সমাপ্তি প্রতিবেদন এবং প্রযুক্তিগত সমাপ্তি প্রতিবেদনের কাজ চলছে। প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হলেও ভূমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়নি। ভূমি অধিগ্রহণের বরাদ্দের টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ সম্ভব না হওয়ায় ডিপিপি সংশোধন করা হয়েছে। আর সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী কাজ শেষ করা হয়েছে।