বাণিজ্য উপদেষ্টা এস কে বশির উদ্দিন শুক্রবার বলেছেন, বাংলাদেশে সংস্কারের পথে বাধা সৃষ্টি করছে একটি প্রোথিত ‘চক্র’, যার মধ্যে রয়েছে প্রশাসন, ব্যবসায়ী মহল, সেনাবাহিনী, গণমাধ্যম, এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও।
প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত সাফা আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমরা একটি ভণ্ডামিপূর্ণ, অপরাধপ্রবণ চক্র দেখছি, যা সমাজের প্রতিটি স্তরে অগ্রগতি ও জবাবদিহিতা বাধাগ্রস্ত করছে। এমনকি জাতীয় মসজিদের ইমামকেও পালিয়ে যেতে হয়েছে—এটি সমস্যার গভীরতা নির্দেশ করে।’
তিনি এই প্রতিরোধকে সমাজজুড়ে বিদ্যমান একটি দীর্ঘমেয়াদি সংকট হিসেবে উল্লেখ করেন এবং অতীতের গণআন্দোলনের সঙ্গে এর যোগসূত্র টানেন, যার মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান— যা ‘হাজারো প্রাণ এবং অব্যাহত ভোগান্তির’ বিনিময়ে সংঘটিত হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
হিসাব ও আর্থিক পেশাজীবীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, “এই গুণীজনদের সম্মেলনে আপনাদের দায়িত্ব হলো স্বচ্ছ ও ন্যায্য আর্থিক প্রতিবেদন নিশ্চিত করা।”
তিনি অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের জন্য একটি সম্মত সংস্কৃতি এবং সম্পদের ন্যায্য বণ্টনের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘আমরা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, সেখানে পৌঁছাতে হলে সঠিক উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তাহলে দেশের সামনে রয়েছে একটি স্বর্ণালী ভবিষ্যৎ।’
অর্থ পাচার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ভুয়া বাণিজ্যের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, আর্থিক বিবরণীতে জালিয়াতি করা হয়েছে। বাংলাদেশ এর চেয়ে অনেক ভালো কিছু পাওয়ার যোগ্য।’
ম্যাক্রো অর্থনীতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অতিমূল্যায়ন ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে হস্তক্ষেপ করছে, তবে অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার বিষয়ে তিনি সতর্ক করেন। তাঁর ভাষায়, ‘হস্তক্ষেপের একটা সীমা আছে। প্রকৃত চালক হলো বিনিময় হার ও সুদের হার।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য আলোচনা এবং বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে উপদেষ্টা বলেন, শ্রম উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, ইউটিলিটি খরচ নিয়ন্ত্রণ এবং লজিস্টিক দক্ষতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রাকৃতিক কাঁচামাল নেই। তাই উৎপাদনশীলতা ও উদ্ভাবনের ওপর জোর দিতে হবে, যাতে আমরা ন্যায্য প্রতিযোগিতা করতে পারি।’
রাজনৈতিক, বিচারিক ও হিসাব প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে সময়ের সঙ্গে দুর্বল হয়ে পড়েছে, তা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘যদি আমরা সত্যিই বাংলাদেশকে তার যোগ্য অবস্থানে নিতে চাই, তাহলে আমাদের একটি ন্যায্য বণ্টনভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।’
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, স্বচ্ছতা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হিসাবরক্ষকদের ভূমিকা দিন দিন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে।
তিনি ব্যাংক, জ্বালানি ও রাজস্ব খাতে কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যৎ সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি এবং কৌশলগত যোগাযোগ অত্যন্ত জরুরি।
দেবপ্রিয় একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কার পরিকল্পনা, কার্যকর মনিটরিং এবং রাজনৈতিক উত্তরণকে সামনে রেখে প্রস্তুতির ওপর জোর দেন।
শিল্প সচিব ওবায়দুর রহমান বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে শিল্প খাতের বিবর্তিত ভূমিকা এবং প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে।
তিনি বলেন, শিল্প প্রতিযোগিতা, টেকসই উন্নয়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করতে কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।তিনি ঐক্য, স্বচ্ছতা ও অংশীদারিত্বের মাধ্যমে একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গঠনের আহ্বান জানান।
দক্ষিণ এশীয় হিসাবরক্ষকদের সংগঠন সাফা এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে, যার লক্ষ্য হলো আঞ্চলিক পর্যায়ে আর্থিক পেশাজীবীদের মধ্যে স্বচ্ছতা, সম্মতি ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে সংলাপ তৈরি করা।
দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলনের আয়োজন করে ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি), সাফার তত্ত্বাবধানে। এতে সার্কভুক্ত দেশগুলো থেকে ৪০০-এর বেশি প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন।
“সংস্কার। পুনর্দক্ষতা। নতুন কল্পনা: বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ” শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে আয়োজিত এই সম্মেলনে উদ্ভাবন, টেকসইতা ও নৈতিক নেতৃত্বে হিসাব পেশাজীবীদের ভূমিকা তুলে ধরা হচ্ছে।
সম্মেলনের তিনটি কারিগরি অধিবেশন, কর্পোরেট নেতাদের অংশগ্রহণে একটি “Meet the Leaders” সংলাপ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব মো. আবদুর রহমান খান এফসিএমএ-এর উপস্থিতিতে সমাপনী অধিবেশনের মাধ্যমে এ সম্মেলন শেষ হবে।
সূত্র: আমার দেশ।