দেশে ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতে আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) দেশের ব্যাংক খাতে অর্থ লেনদেন কমেছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে অর্থ লেনদেনের একটি জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম মোবাইল ব্যাংকিং, যেটিতেও লেনদেনের পরিমাণ কমেছে। পাশাপাশি ক্রেডিট কার্ডেও লেনদেনের পরিমাণও আগের তুলনায় কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে ব্যাংক খাতে লেনদেন কমেছে প্রায় ৫ শতাংশ। লেনদেনের হিসাবায়নের ক্ষেত্রে চেক, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি), ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংকে আমলে নেয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে দেশের ব্যাংক খাতে পাঁচটি মাধ্যমে মোট লেনদেন হয়েছিল ৩৬ লাখ ১৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময়ে এ লেনদেন ৩৪ লাখ ৪০ হাজার ৫৭ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। সে হিসাবে গত অর্থবছরের তুলনায় ব্যাংক খাতে ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৭৭ কোটি টাকার লেনদেন কম হয়েছে। এক্ষেত্রে লেনদেন কমার হার ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এ সময়ে চেকের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন ১৯ শতাংশের বেশি কমেছে। আর ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন কমেছে ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ লেনদেন কমেছে। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ইএফটি ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন বেড়েছে।
ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, চলতি অর্থবছরে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধান তিন খাত তথা আমদানি, রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির ধারায় আছে। সে হিসাবে মানুষের অর্থের প্রয়োজনীয়তা ও লেনদেন আরো বাড়ার কথা। কিন্তু লেনদেনের পরিসংখ্যানে সেটি দেখা যাচ্ছে না। ব্যাংকে লেনদেন কমে যাওয়ার অর্থ হলো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্থবিরতা এখনো কাটেনি। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিও গত ২১ বছরের সর্বনিম্নে নেমে এসেছে।
তবে ঘুস-দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত কালো টাকার দৌরাত্ম্য কমে যাওয়ার প্রভাবেও ব্যাংক লেনদেন কমে যাচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন কমেছে: চলতি অর্থবছরে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন কমেছে ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে দেশে কার্ডভিত্তিক লেনদেন ছিল ৩ লাখ ৪১ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ লেনদেন ৩ লাখ ২৮ হাজার ২১২ কোটি টাকায় নেমে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, দেশের অভ্যন্তরে এবং বিদেশে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার কমে গেছে।
গত জানুয়ারি মাসের তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে দেশের অভ্যন্তরে ক্রেডিট কার্ডে খরচ কমেছে ৫ শতাংশের বেশি। একইভাবে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশি ক্রেডিট কার্ডে খরচ কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। তবে খরচ বেড়েছে বাংলাদেশে আসা বিদেশিদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারিতে দেশের অভ্যন্তরে ক্রেডিট কার্ডে খরচ হয়েছে ২৯৭ কোটি টাকা। জানুয়ারিতে খরচের পরিমাণ ছিল ৩১৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে দেশের অভ্যন্তরে ক্রেডিট কার্ডে খরচ ১৬ কোটি টাকা কমে গেছে। আর শতকরা হিসাবে ৫.১১ শতাংশ।
আলোচিত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে বিদেশে খরচ করা হয়েছে ৩৮৪ কোটি টাকা. যা তার আগের মাস জানুয়ারিতে এর পরিমাণ ছিল ৪৪৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে বিদেশে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ডে খরচ কমেছে ৬২ কোটি টাকা. যা শতকরা হিসাবে প্রায় ১৬ শতাংশের বেশি। দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারেও পরিবর্তন এসেছে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি ব্যাংকের প্রধান জানান, সরকার পরিবর্তনের আগে সবচেয়ে বেশি ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার ও খরচ হতো ভারতে। এখন যে একেবারে যাচ্ছে না তা নয়। আগে ১০০ জন গেলে এখন যাচ্ছে ১০ জন। এ ছাড়া মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মালদ্বীপে যাওয়া ব্যক্তিদের সংখ্যা খুবই কম। তাদের খরচের পরিমাণও কম। তা ছাড়া ক্রেডিট কার্ডের ওপর হুন্ডি কমে যাওয়ারও প্রভাব পড়েছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়েও লেনদেন কম: এদিকে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে রেকর্ড লেনদেন হয়েছে। কিন্তু পরের মাস ফেব্রুয়ারিতে কমেছে। জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে লেনদেন কমেছে ১২ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল এক লাখ ৭১ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা। আর পরের মাস ফেব্রুয়ারিতে এই মাধ্যমটিতে লেনদেন হয়েছে এক লাখ ৫৯ হাজার ৮০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক মাসে লেনদেন কমেছে ১২ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা।
তবে ঈদকে ঘিরে মার্চ মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেনের পরিমাণ আগের দুমাসের তুলনায় অনেকটাই বেড়ে যায়। কিন্তু এপ্রিলে তা আবার কমে আসে। উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে বিকাশ, রকেট, নগদসহ ১৩টি এমএফএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধিত অ্যাকাউন্ট ২৪ কোটিরও বেশি।
সূত্র: এফএনএস।