রংপুর কৃষি অঞ্চলে নার্সারি ব্যবসার ক্রমবর্ধমান বিকাশে ১ হাজার ৬০ জন উদ্যোক্তাকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি সাড়ে ৬ হাজার বেকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল ও সতেজ রেখেছে।
স্বনির্ভরতা অর্জনের পর নার্সারি মালিকরা তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে উন্নত জীবনযাপন করছেন এবং শত-শত বেকার গ্রামীণ মানুষ জীবিকা নির্বাহ এবং দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য তাদের নার্সারিগুলোতে কাজ করছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) কর্মকর্তারা বলেছেন, অনেক উদ্যোক্তা এবং গ্রামীণ পরিবার নার্সারি ব্যবসার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়েছেন। ফলে, রংপুর কৃষি অঞ্চলে গ্রামীণ অর্থনীতি, পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র, জীববৈচিত্র্য এবং সামগ্রিকভাবে বাস্তুতন্ত্রের উন্নতি হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) কৃষিবিদ মো. আফজাল হোসেন বাসসকে বলেন, বর্তমানে রংপুর কৃষি অঞ্চলের পাঁচটি জেলাতেই বেসরকারি খাতে ২১৬টি নিবন্ধিত এবং ৮৪৪টি অনিবন্ধিত নার্সারি রয়েছে।
এই নার্সারিগুলোতে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কৃষিকর্মী নিযুক্ত আছেন, যারা দৈনিক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মজুরি হিসেবে পেয়ে থাকেন।
কৃষিবিদ আফজাল হোসেন বলেন, চারার চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে-সঙ্গে লাভজনক নার্সারি ব্যবসা সম্প্রসারিত হচ্ছে, যা আরও বেশি লোককে নতুন নার্সারি স্থাপনে অনুপ্রাণিত করছে।
এদিকে, প্রায় ১ হাজার ক্ষুদ্র আকারের ফড়িয়া এবং বিক্রেতারা তাদের দোকানে ফুল, কাঠ, ফল এবং ঔষধি গাছের চারা বিক্রি করছেন অথবা বিভিন্ন নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহ করে রিকশা-ভ্যানে বহন করে ঘরে-ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন।
আফজাল বলেন, নার্সারি উদ্যোক্তা, কৃষি শ্রমিক এবং চারা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নার্সারি চারা উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিপণনের পুরো প্রক্রিয়ায় জড়িত রয়েছেন।
বাসস’র সঙ্গে আলাপকালে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মুহুরিপাড়া গ্রামের উদ্যোক্তা মো. আব্দুল বারী (৩৬) বলেন, দীর্ঘদিন দারিদ্র্যতার সঙ্গে লড়াইয়ের পরে তিনি নার্সারি ব্যবসার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়েছেন। আব্দুল বারী ২০১৯ সালে খাফরিখাল সরদারপাড়া গ্রামে দুই একর জমিতে তার নার্সারি ব্যবসা শুরু করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে আমার নার্সারিতে ৪৫ প্রজাতির বিভিন্ন কাঠ, ফল, ফুল এবং ঔষধি গাছের প্রায় ৩০ হাজার বাড়ন্ত চারা রয়েছে। এই চারার সর্বনিম্ন মূল্য ৩০ লাখ টাকা হতে পারে। বারী এখন পর্যন্ত ১৫ লাখ টাকার চারা বিক্রি করেছেন। তিনি এ বছর ৬ লাখ টাকার চারা বিক্রি করার আশা করছেন। তার নার্সারিতে চারজন পুরুষ এবং একজন মহিলা কাজ করছেন। তারা প্রত্যেকে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা দৈনিক মজুরি পাচ্ছেন।তিনি বলেন, সব খরচ বাদ দিয়ে আমি নার্সারি থেকে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা নিট মুনাফা অর্জন করি।
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম কুর্শা শিকারপাড়া গ্রামের ২৭ বছর বয়সী যুবক মো. রিপন মিয়া ১৫ বছর আগে নার্সারি ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তিনি বলেন, আমি নার্সারি ব্যবসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করি। আমার এক একর ২০ শতাংশ জমি জুড়ে অবস্থিত নার্সারিতে এখন ১৫০ জাতের দেশি-বিদেশি ফল, কাঠ, ফুল এবং ঔষধি গাছের প্রায় ৭০ হাজার বাড়ন্ত চারা রয়েছে। রিপনের এই মৌসুমে তার নার্সারি থেকে ১ লাখ ২০ হাজার চারা উৎপাদন ও বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, নার্সারি ব্যবসা পরিচালনার সব খরচ বাদ দিয়ে আমি বার্ষিক ৬ লক্ষ টাকা নিট মুনাফা অর্জন করি। তবে, চলতি মৌসুমে ১ লাখ ২০ হাজার চারা বিক্রি করে আমি ৮ লাখ টাকা আয় করার আশা করছি।
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ঝাড়বিশলা গ্রামের নার্সারি মালিক মো. আব্দুল ওহাব (৩৮) গত ১৬ বছরে নার্সারি ব্যবসার মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তনের তার গল্প বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি ২০০৮ সালে লিজ নিয়ে এক টুকরো জমিতে একটি নার্সারি স্থাপন করি। পরবর্তীতে ২০১১ সালে আমি দেড় বিঘা জমি কিনি এবং আমার নার্সারি ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য আরও এক বিঘা জমি লিজ নিয়েছিলাম। বর্তমানে, তিনি বার্ষিক প্রায় দেড় লাখ কাঠ, ফল, ফুল এবং ঔষধি গাছের চারা উৎপাদন করছেন। তিনি বলেন, আমি এই বছরের আগস্টের মধ্যে আমার চারা বিক্রি করে ৫ লাখ টাকার নিট মুনাফা অর্জনের আশা করছি।
রংপুর সদর উপজেলার হরকলি গ্রামের নার্সারি মালিক আব্দুল ওহিদ শেখ নার্সারি ব্যবসায়ের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জন এবং অনেক গ্রামীণ মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে সাফল্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি বলেন, ১৯৯৪ সালে হরকলি গ্রামে ‘নাসিম নার্সারি’ স্থাপনের মাধ্যমে আমি আমার নার্সারি ব্যবসা শুরু করি। তিনি এখন রংপুর সদরের হরকলি, শলেয়াশা এবং রতিরামপুর গ্রাম এবং মডার্ন মোড় এলাকায় ৩৫ একর জমিতে তার নার্সারি সম্প্রসারণ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে তার নিজস্ব ছয় একর জমি এবং লিজে নেওয়া ২৯ একর জমি। তার নার্সারিগুলিতে ১৪ লাখ ফল, কাঠ, ফুল এবং ঔষধি গাছের চারা রয়েছে। সেখানে দেড়শ’ জনেরও বেশি কৃিষ শ্রমিক কাজ করছেন এবং তারা প্রতি মাসে বেতন পেয়ে উন্নত জীবনযাপন করছেন। ওহিদ বলেন, আমি দেশের বিভিন্ন স্থানে আমার উৎপাদিত চারা সরবরাহ এবং বৃক্ষরোপণের মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে ৭ হাজার চারা বিক্রি করি।
গঙ্গাচড়া উপজেলার পশ্চিম খাফরিখাল গ্রামের ৩২ বছর বয়সী শুধাংশু রিশি বলেন, তিনি বিভিন্ন নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহ করেন এবং প্রতিদিন তার ভ্যানগাড়িতে করে বিভিন্ন বাজার ও গ্রামে বিক্রি করেন। এতে করে তার এবং গড়ে মাসে ২০ হাজার টাকা আয় হয়।
রংপুর সদর উপজেলার হরকলি চওড়াপাড়া গ্রামের ৩২ বছর বয়সী চারা বিক্রেতা এরশাদুল হক বলেন, তিনি বিভিন্ন নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহ করেন এবং তার ভ্যানগাড়িতে করে বিভিন্নস্থানে নিয়ে গিয়ে লোকজনের কাছে বিক্রি করেন। এতে করে তিনি তিনি মাসিক ১৫ হাজার টাকা আয় করতে পারায় উন্নত জীবনযাপন করেন।
সূত্র: বাসস