বিশেষ প্রতিবেদক : পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলায় গত ১ এপ্রিল,২০২৪খ্রি: তারিখে নতুন ইউএনও যোগদান করেছেন। তার নাম মোছা: নাজমুন নাহার । তার অগ্রজ ইউএনও মো. আরাফাত হোসেন এডিসি হয়ে বগুড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যোগদান করেছেন। মাঠ প্রশাসনে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের পদটি খুবই গুরুত্বপুর্ণ। শাসন বিভাগের অধীনস্থ উপজেলা প্রশাসনে সর্বোচ্চ আমলা তিনি। এজন্য তাদের উপর রাষ্ট্র কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্য যেমন গুরুত্বপুর্ণ তেমনি সাধারণ মানুষের কল্যাণে পরিচালিত কর্মগুলোও ততধিক গুরুত্বপুর্ণ। কখনো কখনো তারা নিজ কর্মস্থলে জ্ঞান চর্চার কতিপয় বাতিঘর প্রতিষ্ঠা করেন। যা সেখানকার অধিবাসীর সন্তানদের জীবন আলোকিত করে। এটা নি:সন্দেহে তার জন্য দোয়া,ভালোবাসা ও আশীর্বাদের জায়গা।
সরকারের নীতিমালা ও নির্দেশনা বাস্তবায়নে তিনি সদা অবিচল। তবে রুটিন ওয়ার্কের বাইরেও তিনি কিছু কাজ করে থাকেন। যা জনকল্যাণ মুলক। কারণ প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তা হিসাবে জনসেবার কাজটি তার মূখ্য। নির্দিষ্ট কাজগুলো করে তিনি মাঠ প্রশাসনে দক্ষতা প্রমাণ করতে পারেন কিন্তু জনগণের সন্তোষ্টি অর্জনে আনুষঙ্গিক কাজের পরিধি বাড়াতে না পারলে তিনি বদলি হওয়ার সাথে সাথেই হারিয়ে যান। এজন্য নির্বাহী কর্মকর্তারা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকায় সামাজিক ও সেবামুলক কিছু কাজ করে থাকেন।
ভাঙ্গুড়া উপজেলায় এরকম কয়েকটি বাতিঘরের নাম উল্লেখ করা যায়। এগুলো হলো ‘নির্ঝরিণী লাইব্রেরী’,ল্যাংগুয়েজ ক্লাব,এথিক্স ফাউন্ডেশন,শিল্পকলা একাডেমি। যেগুলো মো.আরাফাত হোসেনের সময় বেশিরভাগ নিষ্প্রভ হয়েছিল। এগুলো কি এখন আবার আলোকিত হবে ? এ প্রশ্নের উত্তরের আগে পুর্বতন ইউএনও’দের উল্লেখযোগ্য কল্যাণমুলক কাজগুলো একনজর দেখে নেওয়া যায়।
** প্রথম ইউএনও এ.এম.এম ফরহাদ খুবই অভিজাত পরিবারের সন্তান(বর্তমানে আমেরিকায় আছেন)। তার সময়ে উপজেলা পরিষদের মুল উন্নয়ন বা প্রশাসনিক ভবনগুলো নির্মিত হয়। তার চমৎকার ব্যবহার ও বিনয়ী আচরণ সবার মনে দাগ কেটে আছে। প্রশাসনের প্রকৃত আফিসারের পদ ও মর্যাদা পুরোটাই তিনি রক্ষা করতে পেরেছিলেন। আজও তাকে সবাই শ্রদ্ধার সাথে মনে রেখেছেন।
** ভাঙ্গুড়া উপজেলায় ১৫/২০ বছর আগে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন মো.মিজানুর রহমান(বর্তমানে ডিজি,ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট)। তিনি উপজেলা পরিষদ আঙ্গিনায় সেবাব্রতি কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠা করেন। আজ তার কলেবর বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তার পাশেই তিনি নির্মাণ করেন ঈদগাহ মাঠ,উপজেলা জামে মসজিদ( সেটা ভেঙ্গে বর্তমানে তৈরি হয়েছে মডেল মসজিদ)। এর নিকটে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হেফজখানা তালেমুল কোরান শিক্ষার প্রতিষ্ঠান যা এখনো চালু আছে। পরিষদ মাঠে শিশু পার্কের ভিত্তি তিনি করেছিলেন। এর পাশে তিনি নির্মাণ করেন শহীদ মিনার। ছিন্নমুল পরিবারের শিশুদের ডেকে প্রায়ই তিনি উন্নত খাবার পরিবেশন করতেন। এছাড়াও জনসেবার অসংখ্য উদাহরণ তিনি রেখে গেছেন যা আজও এখানকার মানুষের মুখে শোনা যায়।
** এর পূর্ববর্তী ও পরের অনেকেই সামাজিক ও সেবামুল কাজ করেছেন তবে উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ইউএনও মো.আসাদুল হক (বতর্মানে ডিএস) অন্যতম। যিনি অফিসারস ক্লাবকে প্রানবন্ত করে গেছেন। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে তদারকি ও মনিটরিং এর মাধ্যমে আমুল পরিবর্তন করেছিলেন। তখন এখানকার শিক্ষার্থীরা জেলার সুনাম বয়ে আনে।
** তার অনুজ ইউএনও মো. শামসুল আলম(ডিএস,বর্তমানে লন্ডনে পিএইচডি করছেন)। তিনি ভাঙ্গুড়া উপজেলার নামকরণ করেন “নৈতিক ভাঙ্গুড়া”। তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষার মানোন্নয়নে ব্যাপক কর্মসুচী গ্রহন ও বাস্তবায়ন করেন। যা শিশুদের আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। এতে বাচ্চারা নিজেদের স্বনির্ভর করতে শেখে। একই সঙ্গে তারা হৃদয়বান,পরোপকারী,আত্মনির্ভশীল ও দেশ প্রেমিক হয়ে ওঠার দীক্ষা লাভ করে। তিনি এখানে একটি ইথিক্স ফাউন্ডেশন নামে নৈতিক শিক্ষা চর্চার সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে ভুয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
** পরবর্তী ইউএনও সৈয়দ আশরাফুজ্জামান এখানে শুদ্ধাচার ও শিষ্ঠাচারের নীতিমালাগুলো অভ্যাসে পরিণত করতে কাজ করেছেন। মানুষ হিসাবেও তিনি অসারণ । তিনি নবজাতক সন্তান ভুমিষ্ঠের দিনই তাকে জন্ম নিবন্ধনের সনদ পৌঁছে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে নতুন শিশুর জন্মদানের জন্য জন্মদাত্রীকে ফুলের তোড়া নিয়ে অভিনন্দন জানাতে তার বাড়িতে হাজির হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি নরম্যাল ডেলিভারীকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ ও শিশু পার্কের সৌন্দর্য বর্দ্ধনে তিনি অবদান রাখেন।
** পরবর্তী ইউএনও মোহাম্মদ নাহিদ হাসান খান(বর্তমান ইউএনও রায়গ্ঞ্জ,সিরাজগঞ্জ)এখানে যোগদান করেই ব্যক্তি উদ্যোগে শিশু পার্কে নির্মাণ করেন উন্মুক্ত মিনি লাইব্রেরী। যার নামকরণ করেন তিনি ‘‘নির্ঝরিণী”। এর আশপাশের সৌন্দর্য বর্ন্ধনসহ সুন্দর বসার ব্যবস্থাও করেন। এছাড়া নির্ঝরিনীর নির্মাণ শৈলী সবাইকে আকৃষ্ট করে। লাইব্রেরী সার্বক্ষণিক খোলা থাকায় বইপ্রেমি লেকক,কবি-সাহিত্যিক ও শিশুরা এখানে নিয়মিত বসতেন। অন্যান্য সব বইয়ের পাশাপাশি শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত শিশুতোষ বই রয়েছে। বয়সী লোকেরা ,শিশু ও টিনএজের শিক্ষার্থীরা সকাল-বিকাল,সন্ধ্যা,রাত যখন সময় পেতেন তারা নির্ঝরিনীতে বসে বই পড়তেন। অল্প সময়ের মধ্যে নির্ঝরিণী মিডিয়া ও গুগলে ফেমাস হয়ে যায়।
ইউএনও নাহিদ হাসান ঢেলে সাজান ভাঙ্গুড়া অফিসারস ক্লাব। তার প্রচেষ্টায় সরকারের নিবন্ধন পায় ক্লাবটি। এর আধুনিকরণে তার অবদান অনেক। তার পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্পকলা নতুনভাবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ পায়। তারই তত্তাবধানে সেবাব্রতি এখন আধুনিক রুপ পেয়েছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সবার জন্য ভাষা চর্চায় তিনি অফিসারস ক্লাবের আঙ্গিনায় প্রতিষ্ঠা করেন ল্যাংগুয়েজ ক্লাব। এখানে মাতৃভাষার যেমন শুদ্ধ চর্চা করা হতো, তেমনিভাবে ইংরেজি লেখা ও বলায় দক্ষতার পাঠদান চলতো। ইউএনও নিজে সপ্তাহে শুক্রবার ও শনিবার সন্ধ্যায় ক্লাশ নিতেন। সরকারি কলেজের সহয়োগী অধ্যাপক বিদ্যুত কুমার রায় তাকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করতেন। এর ফলশ্রæতিতে অংশগ্রহনকারী শিক্ষার্থীরা ভাষা চর্চায় তথা ইংরেজিতে পারদর্শীতা অর্জন করে। অথচ তিনি চলে যাবার পর এসব বাতিঘর নিষ্প্রভ হয়ে গেছে।
শরৎনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির ছাত্র আব্দুল্লাহ নুর তুষার ইংরেজি কুইজে শতভাগ নম্বর পেয়ে এবার রাজশাহী বিভাগ শ্রেষ্ঠ হয়ে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দিতার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। মমতাজ-মোস্তফা আইডিয়াল স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র হুজাইফা অনর্গল শুদ্ধ ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। উপজেলার প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি নিজস্ব ওয়েবসাইট খুলে দেওয়ার কাজ শুরু করেন। ইতোমধ্যে অনেকগুলো স্কুল সেখানে তাদের তথ্য আপডেট করতে পারছে।
** পরবর্তী ইউএনও মো. আরাফাত হোসেন নরম,বিনয়ী ভদ্র হলেও এগুলোর প্রতি তার তেমন নজর ছিলনা। হয়তো অল্প সময়ের জন্য (তিন মাস)এসেছিলেন তাই! এডিসি পদে পদায়নের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। তবে তিনি নির্ঝরিণী লাইব্রেরীতে দর্শক যাতায়াত বন্ধ রেখে সমালোচনার মুখে পড়েন। এ বিষয়ে যুগান্তরে তিনি নেতিবাচক শিরোনাম হন। ল্যাঙগুয়েজ ক্লাবের যাত্রাও থেমে যায় তার সময়ে। ফলে এখানকার মানুষের অন্তরে তিনি খুব একটা বেশি দিন থাকবেন না বলেই ধরে নেওয়া যায়। তবে এখান থেকে তার পদোন্নতিকে সবাই স্বাগত জানিয়েছেন।
** তাদের অনুজ ইউএনও মোছা: নাজমুন নাহার। ভাঙ্গুড়া উপজেলায় তিনি সদ্য যোগদান করেছেন। তার আগমন ও বরণ দেখে মনে হয় তিনি একজন স্মার্ট ও জিনিয়াস অফিসার। নারী ইউএনও হিসাবে এখানে তিনি দ্বিতীয়। তার সঙ্গে রয়েছেন সহকারী কমিশনার(ভুমি)তাসমিয়া আক্তার রোজি। তিনিও অত্যন্ত দক্ষ ও মেধাবী অফিসার। তার মধ্যে অনেক প্রতিভাও রয়েছে। মিডিয়ার চোখে দু’জনে চমৎকার জুটি। এজন্য তাদের কাছে এখানকার মানুষের প্রত্যাশা আরো বেশি। এছাড়া রয়েছেন উপজেলার সকল কর্মকর্তা ,যারা প্রত্যেকে দক্ষ,অভিজ্ঞ,বিনয়ী ও উচ্চ শিক্ষিত । স্ব স্ব ক্ষেত্রে তাদের ব্যাপক সুনাম রয়েছে। তাদের মধ্যে ইউনিটিও রয়েছে। পরস্পর তারা ভাতৃপ্রতীম ও সৌহাদ্যর্পুণ সম্পর্ক বাজয় রেখেছেন।
পরবর্তী ইউএনও’সহ সবাই মাননীয় সংসদ সদস্য আলহাজ মকবুল হোসেন মহোদয়ের পুর্ণ সহযোগিতা পেয়েছেন। এনাদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবেননা। দীর্ঘ সময়ের সংসদ সদস্য,সৎ ও বিচক্ষণ রাজনীতিক হিসাবে মাননীয় সাংসদ প্রধানমন্ত্রীর নিকট যেমন বিশবস্ত ও আস্থাভাজন ,তেমনি এলাকার গণমানুষের কাছেও অত্যধিক জনপ্রিয়। উন্নয়ন ও সেবামুলক কাজে তার সহযোগিতা অব্যাহতভাবেই তারা পেতে পারেন। শুধু সততা ও দক্ষতার সাথে ক্রিয়েটিভ চিন্তা-ভাবনায় জনকল্যাণ কে প্রাধান্য দিতে হবে | তখন নিষ্প্রভ বাতিঘরগুলো আবার আলোর মুখ দেখবে বলে আশা করা যায়।