মোঃ মুন্না হুসাইন তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধিঃ
চলনবিলে এবার মাছের উৎপাদন প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। তাড়াশ মৎস্য বিভাগ দাবি করছে, মাছের উৎপাদন যে হারে বেড়েছে তাতে এ বছরে শুঁটকি মাছের উৎপাদন ২০০ টন ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চলনবিল শুধু মৎস্য ভাণ্ডারই নয়, দেশে বিদেশে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। প্রতিদিন অনেক পর্যটক নৌভ্রমণের জন্য আসেন দেশের সর্ববৃহৎ এই বিলে। জেলেদের কাছ থেকে পছন্দের তাজা মাছ ক্রয় করেন অনেকে।
এতে জেলেরাও লাভবান হচ্ছেন। প্রায় সারা বছরই পর্যটকেরা চলনবিলে নৌভ্রমণে আসেন। বিলের পানিতে ফুটে থাকা শত সহস্র সাদা-লাল-নীল শাপলা, পাখির কলকাকলী ও মাছরাঙার মাছ শিকারের দৃশ্য উপভোগ করেন। সিরাজগঞ্জ শহরের আক্তার হোসেন বলেন, তিনি প্রতি শুক্রবার সপরিবারে চলনবিলে নৌভ্রমণে আসে এবং ফিরে যাওয়ার সময় সপ্তাহের প্রয়োজনীয় মাছ কিনে নিয়ে যাই। শহরের চেয়ে এখানে মাছের দাম কম এবং তাজা মাছ পাওয়া যায়। পর্যটকদের কাছে মাছ বিক্রি করে জেলেদেরাও লাভবান হচ্ছেন।
এতে তাদের মুখে হাসি ফুটেছে। স্থানীয় জেলেরা বলেন, বর্ষার পানি যখন নামতে শুরু করে তখন পানির সাথে বড় বড় মাছ যমুনা নদীতে চলে যায়। এবার চলনবিলে জেলেদের জালে বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর মাছ ধরা পড়ছে। হাট-বাজারে মাছ দামে বিক্রি হচ্ছে। এ দিকে ইতোমধ্যে অনেক চাতালে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে এবার শুঁটকির প্রধান বাজার নীলফামারীর সৈয়দপুরে শুঁটকির দাম কম, বিকল্প বাজার না পাওয়ায় চাতাল মালিকরা লোকসানের আশঙ্কায় হতাশায় ভুগছেন। চলনবিল অঞ্চলে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কিংবা বিপণনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই। এ কারণে অনেক সময় জেলেরা কম দামে মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হয়। বিলের মাছকে কেন্দ্র করে তাড়াশের মহিষলুটি ও নাটোরের সিংড়ায় মাছের আড়ৎ গড়ে উঠেছে। কিন্তু দালালদের কারণে জেলেরা মাছের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এ অঞ্চলে মাছ সংরক্ষণের জন্য হিমাগার না থাকায় জেলেরা লাভবান হতে পারছেন না। মৎস্যভাণ্ডার খ্যাত এ অঞ্চলের বিভিন্ন পয়েন্টে ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টার, ফিশ কোল্ডস্টোরেজ এবং বরফ উৎপাদন করখানা তৈরি করা যেত তাহলে মৎস্য চাষিরা তাদের মাছ সংরক্ষণ করে ভালো দামে বিক্রি করতে পারতেন। সেই সাথে মাছ প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রফতানি করা সম্ভব হতো। নাটোর মৎস্য বিভাগ জানায়, ১৬টি নদী, ২২টি খাড়ি ও ৩৯টি বিলের সমন্বয়ে গঠিত দেশের বৃহত্তম মিঠাপানির দেশী প্রজাতির মাছের উৎস চলনবিল। প্রায় ৮০ প্রজাতির দেশী মাছের জোগান পাওয়া যেত। যদিও কালের বিবর্তনে অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তারপরেও সবচেয়ে বেশি প্রজাতির দেশী মাছ উৎপাদনের মূল উৎস এখনো চলনবিন।
রুই, লওলা, কালবাউশ, মৃগেল, কাতল, চিতল, আইর, বোয়াল, পুঁটি, টেংরা, বায়েম, খলসে, গুচিবাইম, সরপুঁটি, বেলেসহ প্রায় ৬০ প্রজাতির মাছ জেলেদের জালে ধরা পড়ছে। প্রতি কেজি পুঁটি ও চাটা খইলসা ১০০ টাকা, ছোট ছোট বোয়াল, কৈ, মাগুর, জিয়ল, ট্যাংরা, গুচিবাইম ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, আর রুই, কাতলা, বড় বাইম, মৃগেলের দাম ওজন ভেদে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। তাড়াশের মৎস্যজীবী আলামিন হোসেন ও বেল্লাল হোসেন,বলেন, খড়া জালে প্রতি ৩-৫ মিনিট পর ২-৩ কেজি ছোট-বড় মাছ উঠে আসছে। আর কারেন্ট জালে ছোট মাছ পরিমাণে বেশি আটকা পড়ায় জাল বাড়িতে এনে স্ত্রী সন্তান নিয়ে মাছ ছাড়াতে হচ্ছে। তাড়াশের উপজেলার মোঃ শহিদুল ইসলাম মৎস্য চাষি বলেন, আমি নিজে ৪০ বিঘা পুকুরে বড় মাছ চাষ করছি। শনিবার সকালে তিন টন মাছ বিক্রি করার জন্য মহিষলুটি আড়তে যাই চলনবিলের প্রচুর পরিমাণে দেশী মাছের কারণে রড় রড় রুই কাতলা মাছ বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করি। এতে আমার অনেক টাকা লোকসান হয়েছে। যদি মাছ সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকত তাহলে চলন বিল এলাকার মাছ কম দামে বিক্রি করতে হতো না।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশগুল আজাদ বলেন, মৎস্য বিভাগ থেকে প্রতি বছর বিল, নদী, জলাশয়ে দেশী প্রজাতির মাছ ছাড়া হয়। ফলে দেশে আশানুরূপ মাছের উৎপাদন বেড়েছে। এবার চলনবিলের নদী, খাড়ি ও বিলের বিশাল এলাকায় দেশী মাছের প্রজনন বেশি হয়েছে। এতে মাছের ডিম উৎপাদন ও ডিম থেকে মাছ উৎপাদনের সময় চলনবিল জলমগ্ন থাকায় মাছের উৎপাদন প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। চলতি মওসুমে চলনবিল অঞ্চলে শুঁটকি মাছ উৎপাদন ২০০ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে মৎস্য কর্মকর্তা জানান।