পরকালীন জীবনে বিশ্বাস ঈমানের অংশ। মুমিন মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের পুনরুত্থান ও বিচার, শাস্তি ও পুরস্কার, জান্নাত ও জাহান্নামে বিশ্বাসী। পবিত্র কোরআনে মানবজাতিকে বারবার পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন শিঙায় ফুঁক দেওয়া হবে, তখন তারা কবর থেকে ছুটে আসবে তাদের প্রতিপালকের দিকে। … এটা হবে কেবল এক মহানাদ। তখনই তাদের সবাইকে উপস্থিত করা হবে আমার সামনে। আজ কারো প্রতি কোনো অবিচার করা হবে না এবং তোমরা যা করতে কেবল তারই প্রতিফল দেওয়া হবে।’ (সুরা : ইয়াসিন, আয়াত : ৫১, ৫৩-৫৪)
পরকালে মানুষ কাজের পরিণতি ভোগ করবে এবং কর্মফল হিসেবে কিছু বিষয় মানুষের পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে। পরকালে মানুষের পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে এমন সাতটি বিষয়ে আলোচনা করা হলো।
এক. কবর : পরকালীন জীবনের প্রথম ধাপ হলো কবর। কবর থেকেই শুরু হবে ব্যক্তির ভালো ও মন্দ কাজের পরিণতি ভোগ করা। জান্নাতিরা সেখানে শান্তিতে থাকবে আর জাহান্নামিরা শাস্তি ভোগ করবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা বলবে, হায় আমাদের দুর্ভোগ, কে আমাদেরকে আমাদের নিদ্রাস্থল থেকে ওঠাল। দয়াময় আল্লাহ তো এরই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং রাসুলরা সত্যই বলেছিলেন।’ (সুরা : ইয়াসিন, আয়াত : ৫২)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী (সা.) দুটি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি বললেন, ওই দুজনকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে আর কোনো কঠিন কাজের কারণে তাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না। অতঃপর তিনি বললেন—হ্যাঁ, তাদের একজন পরনিন্দা করে বেড়াত, অন্যজন তার প্রস্রাবের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করত না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৩৭৮)
দুই. পুনরুত্থান দিবস : কিয়ামত বা পুনরুত্থান দিবস সবার জন্য সমান হবে না। সেদিন কারো চেহারা হবে দীপ্তিময়, আবার কারো চেহারা হবে কালো। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সেদিন কতক মুখ উজ্জ্বল হবে, কতক মুখ কালো হবে। তাদের বলা হবে—ঈমান আনার পর তোমরা কি কুফরি করেছিলে? সুতরাং তোমরা শাস্তি ভোগ করো, যেহেতু তোমরা কুফরি করতে।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৬)
তিন. দাঁড়িপাল্লা : মানুষের আমলের হিসাব নিতে পরকালে দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করা হবে। ওজনে যার পাল্লা ভারী হবে সে মুক্তি পাবে এবং যার পাল্লা হালকা হবে শাস্তির মুখোমুখি হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তখন যার পাল্লা ভারী হবে, সে লাভ করবে সন্তোষজনক জীবন। কিন্তু যার পাল্লা হালকা হবে তার স্থান হবে হাবিয়া (জাহান্নাম)।
(সুরা : কারিআ, আয়াত : ৬-৯)
প্রকৃতার্থে মানুষ আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া শুধু আমলের হিসাব দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) পরকালের হিসাব সম্পর্কে বলেন, ‘তা (হিসাব গ্রহণ) কেবল হিসাব প্রকাশ করার জন্য। কিন্তু যার হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নেওয়া হবে সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১০৩)
চার. আসমান ও জমিন : মানুষের কাজের সাক্ষী আসমান ও জমিন। কিয়ামত দিবসে মানুষের কর্মফল অনুযায়ী তার পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে আসমান ও জমিন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) পাঠ করলেন—সেদিন পৃথিবী তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে (সুরা : জিলজাল, আয়াত : ৪) এবং বলেন, তোমরা কি জানো পৃথিবীর বৃত্তান্ত কী? সাহাবিরা উত্তর দিলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন। মহানবী (সা.) বললেন, তার বৃত্তান্ত হলো ভূপৃষ্ঠে প্রত্যেক নর-নারী যা করে। সে বলবে, সে অমুক দিন এটা এটা করেছে।’ (সুনানে তিরমিজি)
পাঁচ. অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ : পরকালে ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যক্তির ভালো-মন্দ কাজের বিবরণ দেবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আজ তাদের মুখ মোহর করে দেব। তাদের হাত কথা বলবে আমার সঙ্গে এবং তাদের পা সাক্ষ্য দেবে তাদের কৃতকর্মের।’ (সুরা : ইয়াসিন, আয়াত : ৬৫)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘পরিশেষে যখন তারা জাহান্নামের সন্নিকটে পৌঁছাবে, তখন তাদের কান, চোখ ও ত্বক তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে, তাদের বিরুদ্ধে।’ (সুরা : হা-মিম সাজদা, আয়াত : ২০)
ছয়. ফেরেশতা : পরকালে মানুষের পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবেন ফেরেশতারা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আছে তোমাদের জন্য তত্ত্বাবধায়কগণ, সম্মানিত লিপিকারবৃন্দ।’ (সুরা : ইনফিতার, আয়াত : ১০-১১)। অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘সেদিন প্রত্যেক ব্যক্তি উপস্থিত হবে, তার সঙ্গে থাকবে চালক ও সাক্ষী।’ (সুরা : কাফ, আয়াত : ২১)
আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘চালক দ্বারা উদ্দেশ্য যে ফেরেশতা তার আমল লিপিবদ্ধ করত।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)
সাত. নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য : পরকালে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার পর মানুষ ও জিন নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তাদের বলব, হে জিন ও মানব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্য থেকে কি রাসুলরা তোমাদের কাছে আসেনি—যারা আমার নিদর্শন তোমাদের কাছে বিবৃত করত এবং তোমাদেরকে এই দিনের মুখোমুখি হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করত? তারা বলবে, আমরা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলাম। বস্তুত পার্থিব জীবন তাদের প্রতারিত করেছিল, আর তারা নিজেদের বিরুদ্ধে এ সাক্ষ্য দেবে তারা অবিশ্বাসী ছিল।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১৩০)