২০২৪ সালে বিশ্বের দুই বড় জালিমের পতন হয়েছিল। ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনার এবং ৮ ডিসেম্বর সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের। উভয়েই স্বজাতির স্বার্থের বিরুদ্ধে বিদেশিদের তোষণ করে ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। উভয়ই নিজের দেশ ছেড়ে পালিয়ে জনরোষ থেকে প্রাণ বাঁচান। এটা তাদের দুনিয়ার পতন, তবে জালিমের আসল শাস্তি রয়েছে আখিরাতে।
ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। আল্লাহ যুগে যুগে জালিমদের পাকড়াও করেছেন। তথাপি যুগে যুগে নতুন জালিমের সৃষ্টি হয়। তারা নিজেদের সর্বক্ষমতার অধিকারী ভেবেছিল, ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিল ও জুলুম করেছিল। বিশ্ববাসীর জন্য আল্লাহ তাদের দৃষ্টান্তস্বরূপ পেশ করেছেন, যাতে পরবর্তী সময়ে যারা আসবে তারা শিক্ষা লাভ করতে পারে। ‘আমি কারুন, ফিরাউন ও হামানকে ধ্বংস করেছিলাম। মুসা তাদের কাছে উজ্জ্বল নিদর্শন নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু তারা ভূমিতে দম্ভ করল, তারা আমার শাস্তি এড়াতে পারেনি।
প্রত্যেককেই আমি তাদের পাপের কারণে পাকড়াও করেছিলাম; তাদের কারো প্রতি প্রেরণ করেছি প্রস্তরসহ প্রচণ্ড ঝটিকা, কাউকে আঘাত করেছিল মহানাদ, কাউকে আমি ধসিয়ে দিয়েছিলাম ভূগর্ভে এবং কাউকে করেছিলাম নিমজ্জিত। আল্লাহ তাদের প্রতি কোনো জুলুম করেননি; তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল। …আমি মানুষের কল্যাণার্থে এসব দৃষ্টান্ত দিয়ে থাকি, কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তিরাই কেবল তা বোঝে।’ (সুরা আনকাবুত : ৩৯-৪৩)
নিচে পৃথিবীর ক্ষমতাধর কয়েকজন জালিমের জুলুম ও তাদের পরিণতি তুলে ধরা হলো—
ক্ষমতার দাপটে ও ঔদ্ধত্যে বিভোর ফিরাউন
ঔদ্ধত্যের কারণে ফিরাউন ও কওমের পরিণতি
ফিরাউন ও তার বাহিনী জমিনে অন্যায় অহমিকা প্রদর্শন করেছিল। তারা মনে করেছিল তাদের আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না। সুতরাং আমি তাকে ও তার সৈন্যদের পাকড়াও করলাম এবং সাগরে নিক্ষেপ করলাম। এবার দেখো, জালিমদের পরিণতি কী হয়ে থাকে! (সুরা কাসাস : ৩৯-৪০)
কারুন ও তার পরিণতি
‘কারুন ছিল মুসার সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি। কিন্তু সে তাদেরই প্রতি জুলুম করল। আমি তাকে এমন ধনভান্ডার দিয়েছিলাম, যার চাবিগুলো বহন করা একদল শক্তিমান লোকের পক্ষেও কষ্টকর ছিল। স্মরণ করো, তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, দম্ভ করো না, নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিকদের পছন্দ করেন না। …সে বলল, এসব তো আমি আমার জ্ঞানবলে লাভ করেছি। সে কি জানত না যে, আল্লাহ তার আগে এমন বহু মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছিলেন, যারা শক্তিতেও তার অপেক্ষা প্রবল ছিল এবং লোকবলেও বেশি ছিল? অপরাধীদের তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেসও করা হয় না। …পরিণামে আমি তাকে তার প্রাসাদসহ ভূগর্ভে ধসিয়ে দিলাম। তার সপক্ষে এমন কোনো দল ছিল না, যারা আল্লাহর শাস্তি থেকে তাকে সাহায্য করতে পারত এবং সে নিজেও পারল না আত্মরক্ষা করতে। … ওই পরকালীন নিবাস তো আমি সেই সব লোকের জন্যই নির্ধারণ করব, যারা পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য দেখাতে ও ফ্যাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না। শেষ পরিণাম তো মুত্তাকিদের অনুকূলেই থাকবে।’ (সুরা কাসাস : ৭৬-৮৩)
নমরুদ ও তার পরিণতি
তুমি কি ওই ব্যক্তির অবস্থা চিন্তা করনি, যাকে আল্লাহ রাজত্ব দান করার কারণে সে নিজ প্রতিপালকের (অস্তিত্ব) সম্পর্কে ইবরাহিমের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়? যখন ইবরাহিম বলল, তিনি আমার প্রতিপালক যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যুও ঘটান। তখন সে বলল, আমিও তো জীবন দান করি ও মৃত্যু ঘটাই। ইবরাহিম বলল, আচ্ছা, আল্লাহ তো সূর্যকে পূর্ব থেকে উদিত করেন, তুমি তা পশ্চিম থেকে উদিত করো তো! এ কথায় সে কাফের নিরুত্তর হয়ে গেল। আর আল্লাহ এরূপ জালিমদের হেদায়েত করেন না। (বাকারা ২ : ২৫৮)
পৃথিবীতে প্রথম ঔদ্ধত্য প্রদর্শনকারী ছিল নমরুদ। সে-ই আসমান অভিমুখে টাওয়ার নির্মাণ করেছিল। আল্লাহ তাকে শায়েস্তা করার জন্য একটি মশা পাঠান। সেটি তার নাকে প্রবেশ করে। মশার জ্বালা থেকে বাঁচার জন্য তার মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হতো। তার রাজত্ব ছিল ৪০০ বছর। সে যেমন ৪০০ বছর পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল, তেমনি আল্লাহ তাকে ৪০০ বছর এই আজাবে রাখেন। অতঃপর সে মৃত্যুবরণ করে। (তাফসিরে ইবনে কাসির : ২/৮৭৮)
আল্লাহ ছাড় দেন তবে ছেড়ে দেন না
জালিমকে অনেক সময় আল্লাহ তৎক্ষণাৎ পাকড়াও করেন না। তখন জালিম মনে করে তাকে ঠেকানোর মতো কেউ নেই। কিন্তু তার সময় ফুরিয়ে গেলে আল্লাহ তাকে ঠিকই গ্রেপ্তার করেন। ‘আমি ধ্বংস করেছি কত জনপদ, যেগুলোর বাসিন্দা ছিল জালিম। এসব জনপদ তাদের ঘরের ছাদসহ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল এবং অনেক কূপ পরিত্যক্ত হয়েছিল ও অনেক সুদৃঢ় প্রাসাদও। …এবং আমি কত জনপদকে অবকাশ দিয়েছি যখন তারা ছিল জালিম; অতঃপর তাদের শাস্তি দিয়েছি এবং প্রত্যাবর্তন আমারই কাছে।’ (সুরা হজ : ৪৫-৪৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা জালিমকে অবকাশ দেন, তারপর যখন পাকড়াও করেন তখন আর কোনো ছাড় দেন না। তারপর তিলাওয়াত করেন, ‘যেসব জনপদ জুলুমে লিপ্ত হয়, তোমার প্রতিপালক যখন তাদের পাকড়াও করেন, তখন তাঁর পাকড়াও এমনই হয়ে থাকে। বাস্তবিকই তাঁর পাকড়াও অতি মর্মন্তুদ, বড় কঠিন!’ (মুসলিম : ২৫৮৩)
আখেরাতে জালিমের পরিণতি
‘তুমি কিছুতেই মনে করো না জালিমরা যা কিছু করছে, আল্লাহ সে সম্পর্কে বেখবর। তিনি তো তাদের সেই দিন পর্যন্ত অবকাশ দিচ্ছেন, যে দিন চক্ষুগুলো থাকবে বিস্ফারিত। ভীতবিহ্বল চিত্তে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা ছোটাছুটি করবে। নিজেদের প্রতি তাদের দৃষ্টি ফিরবে না এবং তাদের অন্তর হবে উদাস। …সেদিন তুমি অপরাধীদের দেখবে শৃঙ্খলিত অবস্থায়। তাদের জামা হবে আলকাতরার আর আগুন তাদের মুখমণ্ডল আচ্ছন্ন করবে। …এটা এজন্য যে, আল্লাহ প্রত্যেকের কৃতকর্মের প্রতিফল দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণ করেন।’ (সুরা ইবরাহিম : ৪২-৪৩ ও ৪৯-৫০)
লেখক: মাওলানা মুহাম্মাদ ফজলুল বারী
সূত্র: আমার দেশ।