২৯ এপ্রিল হজের প্রথম ফ্লাইট শুরু হয়ে প্রতিদিন উড়াল দিচ্ছে কাবার কাফেলা। হজ ইসলামের পাঁচটি বুনিয়াদের মধ্যে অন্যতম। সামর্থ্যবান মুসলিমের ওপর জীবনে একবার হজ ফরজ। জীবনের সব সঞ্চয় ব্যয় করে দীর্ঘ সাধনা ও স্বপ্নের এই সফর আসলে আখিরাতের সফর। তাই তো হজ মানুষের জীবনকে আমূল বদলে দেয়। এ হজকে জীবনের মোড় পরিবর্তনকারী এবং মাবরুর বানাতে হলে প্রয়োজন এর জন্য যথাযথ প্রস্তুতি। এবার যারা হজ করবেন, তাদের হজ কীভাবে সার্থক বানাবেন, তা নিয়ে ইসলামি স্কলারদের পরামর্শ তুলে ধরেছেন হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর
হাতে-কলমে হজ শিখুন ও বিধিবিধান জেনে নিন
মুফতি আমজাদ হোসেন হেলালী
মুহাদ্দিস, জামেয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা
পবিত্র হজ ইসলামের অন্যতম রুকন। যারা হজের জন্য ইতোমধ্যে হারামাইনের দেশে পৌঁছে গেছেন এবং যারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন ফ্লাইটের জন্য- তাদের করণীয় হলো হজের সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়া। হজের যেসব করণীয় রয়েছে, সেগুলো হাতে-কলমে আলেমদের কাছ থেকে শিখে নেওয়া। যেমন- তালবিয়া শেখা, হজের নিয়মকানুনগুলো শেখা। নিজেকে হজের যাত্রী, মুসাফির হিসেবে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা। বিশেষ করে যখন থেকে হজের জন্য নিয়ত করেন, তখন থেকেই এমনভাবে নিজেকে প্রস্তুত করা যে, হজের মতো বড় আমল যেন যথাযথভাবে সম্পাদন করা যায়। বিশেষভাবে হজের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতগুলো ভালোভাবে মুখস্থ করে নেওয়া। সেই সঙ্গে নিজেকে হজের মুসাফির হিসেবে মনে করে সব সময় আল্লাহতায়ালার কাছে তাওফিক, সুস্থতা ও কবুলিয়াতের দোয়া করা।
হজের সফর হতে হবে রাগ ও গুনাহমুক্ত
মাওলানা আব্দুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ
খতিব, মসজিদুল জুমুআ, মিরপুর
হজের সফর হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সফর। নিজেকে গুনাহমুক্ত করে আল্লাহর কাছ থেকে নিষ্কলুষ হওয়ার সার্টিফিকেট নিয়ে জান্নাতে যাওয়ার পাথেয় অর্জনের সফর। আল্লাহ কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘তোমরা পাথেয় গ্রহণ করো। নিশ্চয়ই উত্তম পাথেয় তাকওয়া।’ (সুরা বাকারা : ১৯৭)
অতএব এ তাকওয়ার অনুশীলন আগে থেকেই শুরু করতে হবে। কিন্তু আমরা হজের দিন থেকেই আমল করব, ইবাদত করব এমন ধারণায় বসে থাকি। অথচ হজের মাস হলো তিনটি। যথা- শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ। হজ আদায়ের মাস একটি হলেও উল্লিখিত তিন মাসকেই হজের মৌসুম বলা হয়েছে। যাতে করে হজযাত্রীরা হজের প্রস্তুতি অনেক আগে থেকেই শুরু করতে পারেন।
হজের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বিশেষত আমার পরামর্শ হলো- স্বদেশের তুলনায় ওখানকার আবহাওয়া ভিন্ন, ওখানে মেজাজও ভিন্ন ধরনের হয়। সেখানে সবাই নামাজ যেন ছুটে না যায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকেন। মিথ্যা কথা মুখ দিয়ে বের করা যায় না। কারণ এ বিষয়ে সবাই বিশেষ সতর্ক থাকেন। তবে হজের সফরে শয়তান সবচেয়ে বেশি প্ররোচিত করেন, গালগল্প, রাগ ইত্যাদিতে লিপ্ত করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে। কারণে-অকারণে রাগের উদ্রেক হলে মানুষ মুখ খারাপ করে, বাজে কথা বলে, আচার-ব্যবহার নষ্ট করে। তাই আগে থেকেই এভাবে নিজেকে প্রস্তুত করা জরুরি, যেন কোনোভাবেই রাগের উদ্রেক না হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে রাগের উদ্রেক হতে পারে সে ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কারণ শয়তান অন্যকিছু দিয়ে আমাদের প্ররোচিত করতে না পারলেও রাগ দিয়ে আমাদের প্ররোচিত করবে। আর তালবিয়ার তাওহিদের শিক্ষাটা আমাদের জীবনে আছে, তা ধারণের চেষ্টা করতে হবে।
হজের সফর গুনাহ ও রাগমুক্ত রাখার জন্য যেমন অভ্যাস দরকার, তা অর্জন করতে হবে। আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়, সেটি হলো- সেখানে প্রচুর হাঁটাহাঁটি করতে হয়। তাই আগে থেকেই শারীরিক কসরত করে সে ব্যাপারেও প্রস্তুতি রাখতে হবে। কেউ যদি মনে করেন সেখানে এসিতে হজের সফর উপভোগ করবেন, সেটা নিতান্তই ভুল। তাই হজের সফরের জন্য প্রয়োজন আধ্যাত্মিক, আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক সব ধরনের প্রস্তুতি রাখা।
লেনদেন পরিশোধ করে হজে যাওয়া উচিত
শায়খ আব্দুল মতিন আজহারী
খতিব, মসজিদুল হিদায়া ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া
যারা হজে যাচ্ছেন, তারা ঋণ পরিশোধ করে যাবেন। কারো আমানত যদি গচ্ছিত থাকে, তাহলে তাদের হাতে তা হস্তান্তর করে যাবেন। আর সম্পদের বিষয়ে আল্লাহর বিধান মতে উত্তরাধিকার সম্পদ বণ্টননীতি অনুযায়ী একটা অসিয়তনামা লিখে দিয়ে যেতে পারেন। সে অসিয়তনামার নিচে লেখা থাকবে ‘আমার এই অসিয়তনামা কার্যকর হবে আমার মৃত্যুর পরে।’ তখন হজ থেকে ফেরত আসার পরও সেই সম্পদের মালিক তিনিই থাকবেন। আর আল্লাহ না করুন, যদি সেখানে মৃত্যু হয়ে যায়, তখনো ওই অসিয়তনামা অনুযায়ী সন্তান, স্ত্রী, মেয়ে তথা ওয়ারিশানের মধ্যে উত্তরাধিকার সম্পদ বণ্টন হবে। যাতে করে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে কোনো ধরনের ভুল বোঝাবুঝি, ঝগড়াঝাঁটি ইত্যাদি না হয়।
রক্তের বন্ধন যাদের সঙ্গে আছে, তাদের সঙ্গে একটু সাক্ষাৎ করে যেতে পারেন। হয়তো এটা কারো কারো ক্ষেত্রে শেষ সাক্ষাৎও হতে পারে। হজে রওনা করার আগে সদকায়ে জারিয়া করে যেতে পারেন। সন্তানরা বাবা-মায়ের জন্য সদকা করবেন, এমন মানসিকতা না রাখা চায়। কারণ অনেক সম্পদশালী সন্তানরা তা করেন না।
সন্তানদের একটা শপথ করিয়ে যেতে পারেন, ‘যে আমরা আল্লাহর দ্বীন মেনে চলার জন্য বদ্ধপরিকর থাকব, কেউ কাউকে ঠকাব না, নিজেদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করব না, সালাত কায়েম করব, জাকাত দেব, সিয়াম পালন করব, আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত রাখার জন্য যা করতে হয় সাধ্যানুযায়ী তা করে যাব।’
আর স্বামীরা বিশেষভাবে নিজেদের স্ত্রীরা বেঁচে থাকলে ক্ষমা চেয়ে নেবেন। সাধারণত আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়ে থাকে ঘরের মধ্যে, যা অন্যরা দেখেন না, তাই স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে মন থেকে ক্ষমা করে দেবেন। হজে গিয়ে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই সীমালঙ্ঘন থেকে বিরত থাকবেন। অনেকে সেখানেও স্ত্রীদের নিয়ে গিয়ে শ্রমিকের মতো খাটান, ধমক দেন। এমনটা কখনো উচিত নয়। কারণ তিনি সেখানে আল্লাহর মেহমান। যিনি আল্লাহর মেহমান, তাকে অসম্মানিত, অপমানিত করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যাদের মেয়ে বিয়ে-শাদির উপযুক্ত আছে, সম্ভব হলে ভালো কোনো ছেলের সন্ধান পেলে আকদ সম্পন্ন করে যেতে পারেন। প্রয়োজনে হজ থেকে ফিরে অনুষ্ঠান করতে পারবেন।
মানসিকভাবে সুদৃঢ় থাকতে হবে
হাফেজ মাওলানা লুৎফর রহমান
সভাপতি, বাংলাদেশ ইমাম সমিতি
আল্লাহর ঘরে যারা হজ করতে যাবেন, তাদের জন্য হজের আগে যে কাজগুলো অত্যন্ত জরুরি, সেখানে উল্লেখযোগ্য হলোÑ অত্যন্ত পরিশুদ্ধ একটি নিয়ত থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, মানসিকভাবে সুদৃঢ় থাকতে হবে। কারণ তিনি সেখানে যাবেন, পরিশ্রম করবেন, আল্লাহর কাছ থেকে কিছু চেয়ে আনবেন, গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করবেন। তাই মানসিক শক্তি ও সুস্থতা অত্যন্ত জরুরি। আর হজ পালনের পূর্বশর্ত হলো হালাল উপায়ে উপার্জিত টাকা দিয়েই হজ সম্পাদন করতে হবে। এরপর একজন হজযাত্রী একটি দীর্ঘ সফরে যাবেন, তাই তাকে সবদিক থেকেই পরিচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া জরুরি। যেমন কারো সঙ্গে আর্থিক লেনদেন থাকলে তা সমাধান করে নেওয়া। কেউ টাকা পেলে আদায় করে দেওয়া। কর্জ আদায়ে গড়িমসি ও সময়ক্ষেপণ না করা। দোয়া ও ক্ষমা চেয়ে নেওয়া।
সেখানকার পরিবেশ যেহেতু ভিন্ন, সেহেতু প্রয়োজনীয় ওষুধ ও আসবাবপত্র সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া। পরিবেশের সঙ্গে সংগতিবিধানে বুঝেশুনে চলা। অস্বাভাবিক কোনো আবেগ সেখানে প্রকাশ না করা। যেমন- হাজরে আসওয়াদ চুমু খাওয়ার জন্য অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করেন অনেকে। অথচ এমনটা উচিত নয়। খুবই নিয়মতান্ত্রিক ও স্থিরভাবে হজের আমলগুলো করার ব্যাপারে যত্নবান থাকতে হব। আর হজের জন্য ধৈর্যও খুবই জরুরি। যেহেতু সেখানে অনেক মেহনতের ব্যাপার আছে। সর্বোপরি যারা মুরব্বি বা মুয়াল্লিম, তাদের নির্দেশনা মেনে চলার প্রতিও যত্নবান থাকা প্রয়োজন।
সূত্র: আমার দেশ।