চশমা মাথায় তুলে বাড়ি তোলপাড় করে হারিয়ে যাওয়া চশমার খোঁজ, কিংবা সারাক্ষণের সঙ্গী মোবাইল খুঁজে না পেয়ে অন্য মোবাইল থেকে রিং করে সন্ধান এমন ছোটখাটো ভুল প্রায় প্রত্যেকেরই জীবনের সঙ্গী। ডিমেনশিয়া বা ভুলে যাওয়া শুধুই যে বয়স্ক মানুষদের সমস্যা, তা নয়। ছোটরাও অনেক সময় পড়া মুখস্থ করার পর লিখতে বসে পেন কামড়ে মাথা চুলকে উত্তর মনে করতে পারে না কিছুতেই।
নিউরোলজিস্টরা বলছেন, বাচ্চাদের পড়া ভুলে যাওয়ার মূলে আছে অমনোযোগ। কিন্তু বড়দের, বিশেষ করে বয়স্কদের ভুলে যাওয়ার পিছনে মস্তিষ্কের অসুখ অ্যালজাইমার ডিজিজ বা পার্কিনসনস থাকতে পারে। আবার রুপোলি পর্দায় যেমন দেখা যায় দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত লেগে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যাচ্ছে, এই রকম ঘটনা বাস্তব জীবনেও ঘটতে পারে। ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলে ‘পোস্ট ট্রমাটিক অ্যামেনশিয়া’। তবে মাথায় আঘাত লাগা মাত্রই যে চেনা মানুষকে ভুলে যাবেন বা কোনও গান শুনে স্মৃতি ফিরে পাবেন, এমন নাটকীয় ঘটনা বিরল। মাথার বিশেষ অংশে চোট লাগার পর সাময়িক ভাবে ভুলে যাওয়ার ঘটনা খুব অস্বাভাবিক নয়। ৪৫% ক্ষেত্রে মাসখানেকেরও বেশি সময় স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়ার ঝুঁকি থাকে। বাকিদের আরও কম সময়ের জন্যে স্মৃতি লোপ পায়, আবার তা ফিরে আসতেও বেশি সময় লাগে না।
আসলে মনে রাখাই হোক কিংবা ভুলে যাওয়া, সবই নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের মস্তিষ্ক। স্নায়ুতন্ত্রের কেন্দ্র মস্তিষ্কের প্রধান তিনটি অংশ হল— সেরিব্রাম, সেরিবেলাম আর ব্রেন স্টেম। মনে রাখা বা না রাখা ছাড়াও একজন মানুষের যাবতীয় শারীরিক ও মানসিক কাজ নিয়ন্ত্রিত হয় ব্রেন থেকেই। মেডুলা, পনস আর মিডব্রেন-এর সমন্বয়ে তৈরি ব্রেন স্টেম মস্তিষ্কের সঙ্গে সুষুম্নাকাণ্ডকে যুক্ত করেছে। আর মস্তিষ্কের এই অংশ নিশ্বাস প্রশ্বাস, হৃদপিণ্ডের লাবডুব, হজম করা সহ যাবতীয় শারীরবৃত্তীয় কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে। মস্তিষ্কের সেরিবেলাম অংশটি শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি মোটর নার্ভকে চালনা করে। মস্তিষ্কের আর একটা ব্যাপার জানলে অবাক লাগবে, মস্তিষ্ক ভাল ঘটনার থেকে খারাপ ঘটনা অর্থাৎ নেগেটিভ ইনফরমেশন বেশি তাড়াতাড়ি মনে করতে পারে। তাই পুরনো দিনের ভাল ঘটনার থেকে ভয় বা কষ্টের ঘটনার কথা বেশি মনে পড়ে।
মস্তিষ্কের সব থেকে বড় অংশ সেরিব্রামের দু’টি হেমিস্ফিয়ার আছে। সেরিব্রাম ঢাকা থাকে সেরিব্রাল কর্টেক্স নামের এক আবরণী দিয়ে। মস্তিষ্কের এই আবরণ আমাদের ভাবনা-চিন্তা, বুদ্ধি, মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি বাড়াতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। সেরিব্রাল কর্টেক্স-এর চারটি লোব বা ভাগ আছে। এদের মধ্যে অ্যামিগডালা ও হিপ্পোক্যাম্পাস অংশ মনে রাখতে সাহায্য করে। হিপ্পোক্যাম্পাস অংশে স্নায়ুকোষ নিউরন তৈরি হয়। বিভিন্ন কারণে নিউরন তৈরির হার কমে গেলে বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া সহ বিভিন্ন অসুবিধে হয়। যখনই ভুলে যাওয়ার ঘটনা বাড়তে থাকে, তখন অবশ্যই কোনও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে ভুলে যাওয়ার জন্য মূলত পার্কিনসন্স ও অ্যালজাইমার নামক মস্তিষ্কের ক্ষয়জনিত অসুখের কথা ভাবা হয়। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের সন্দেহ হলে মিনি মেন্টাল স্টেট এগজামিনেশন বা এমএমএসই টেস্ট করে সমস্যা নির্ণয় করা হয়। এই পরীক্ষায় ৩০টি ছোট ছোট প্রশ্ন করা হয়। ২০ থেকে ২৪ স্কোর হলে বুঝতে হবে মাইল্ড ডিমেনশিয়া। স্কোর যত কম হবে, ভুলে যাওয়ার মাত্রা তত বাড়বে।
স্নায়ু কোষ তৈরির পদ্ধতি এলোমেলো হয়ে যাওয়ার মূলে আছে স্ট্রেস হরমোন গ্লুকোকর্টিকয়েড। বেশি দুশ্চিন্তা, টেনশন, স্ট্রেস হলেই ভুলে যাওয়া শুরু হয়। মাথা ঠান্ডা রাখলে, মন শান্ত থাকলে ভুলে যাওয়ার সমস্যা দূরে সরিয়ে রাখা যায়। যারা দীর্ঘদিন ধরে ডিপ্রেশনে ভুগছেন, তাদের মনঃসংযোগ কমে যাওয়ার পাশাপাশি ভুলে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। বংশে যদি অ্যালজাইমারস বা পার্কিনসন্সের ইতিহাস থাকলে ছোট থেকেই মন ভাল রাখতে গান শোনা কিংবা পছন্দের বাজনা বাজানো বা শোনার অভ্যেস তৈরি করতে হবে বলে পরামর্শ দিলেন অংশু সেন।
বিভিন্ন সমীক্ষায় জানা গেছে যে, শান্ত পরিবেশ স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। অন্য দিকে, কোলাহল ও ভিড়ভাট্টা অনেক ভাল ঘটনার কথাও ভুলিয়ে দেয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ম করে সুডোকু খেলার অভ্যেস করা উচিত।
৬৫ বছর পেরিয়ে গেলে অল্প স্বল্প ভুলে যাওয়ার ঘটনা স্বাভাবিক বলেই ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু ৪০–৪৫ বছর বয়সে ভুলে যাওয়ার সূত্রপাত এবং তা ক্রমশ বাড়তে থাকলে অসুখের সম্ভাবনার কথা ভাবতে হবে। স্মৃতিশক্তি ধারালো রাখতে সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট এক্সারসাইজ করতেই হবে। হিংসে, রাগ, অকারণ ভয় ভুলে মন ভাল রাখতে নিজের জন্যে কিছুটা সময় রাখতে হবে। গান শোনা, গান গাওয়ার পাশাপাশি ধুমপান মদ্যপান ছাড়তে হবে। টাটকা শাক সবজি, ফল, মাছ সহ পুষ্টিকর খাবার খেলে ভুলে যাওয়ার সমস্যা প্রতিরোধ করা যায়।