শিক্ষকদের বেশ বড়সড় একটি আন্দোলন এই মুহূর্তে সমগ্র দেশ দেখছে। এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে সম্ভবত কারো মনে কোন প্রশ্ন নেই; অন্তত বিভিন্ন মিডিয়ার বদৌলতে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষক বা সাধারণ মানুষ বা শিক্ষার্থী-সবার যে বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে তাই মনে হচ্ছে। শুধু তাই নয় বর্তমানে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান নিজ মুখে এই আন্দলনের দাবিগুলোর পক্ষে বলেছেন এবং তার দলের পক্ষ থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তি আকারে এ ব্যাপারে অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। পাশাপাশি প্রখ্যাত ইসলামিক বক্তা মিজানুর রহমান আজাহারী সহ আরও অনেক আলেম এবং চিন্তাবিদ, শিক্ষকদের এই দাবি দাওয়ার পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন। ফলে এই আন্দোলন যে অযৌক্তিক নয় তা অত্যন্ত পরিস্কার।
তার পরেও আলোচনার খাতিরে প্রশ্ন করা যাক- শিক্ষকদের এই আন্দোলন আসলে কি যুক্তি সঙ্গত? যদি যুক্তিসঙ্গত হয় তাহলে তা মেনে নেওয়ার ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ কেন নেওয়া হচ্ছে না? আর যদি যুক্তিসঙ্গত না হয় তাহলে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তাদেরকে সেখান থেকে নিবৃত কেন করার চেষ্টা করা হচ্ছে না?
আন্দোলন একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনের ইতিহাস বহু পুরাতন। এই বাংলাদেশেই বহু আন্দোলন বহু সময়ে সংঘটিত হয়েছে, যার অনেকগুলোই সফল হয়েছে, অনেকগুলোই সফল হয়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ের শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে যে মানবিক আন্দোলন-এটি সবার হৃদয় ছুয়ে গিয়েছে।
একটি দেশের ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা নির্ভর করে সেই দেশে কেমন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে তার ওপরে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এমপিও ভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং তাতে কর্মরত শিক্ষকদের শিক্ষাক্ষেত্রে ভূমিকা কেমন-এটি প্রশ্নাতীত। একই শিক্ষাক্রমে সম্পূর্ণ সমান ভূমিকা রাখা সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের যে বৈষম্য বাংলাদেশে লক্ষ্য করা যায়, তা সমগ্র বিশ্বের প্রেক্ষাপটে সম্ভবত বিরল।
একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় বা একটু তথ্য সংগ্রহ করলেই নিশ্চিত হওয়া যাবে শিক্ষার ক্ষেত্রে অসামান্য ভূমিকা রাখা এমপিও ভুক্ত শিক্ষকদের অর্থনৈতিক সুবিধা কেমন অমানবিক। একবিংশ শতাব্দীর এই বস্তুবাদী পৃথিবীতে সম্মানের সবচেয়ে বড় শর্ত হলো ‘অর্থ’। অথচ রাষ্ট্র বারবার এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এটি অস্বীকার করেছে। আমরা আমাদের শিক্ষকদের সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টি শুধুমাত্র কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। এখান থেকে মুক্তির পথটিও জোর করে বন্ধ করে রেখেছি।
১২ই অক্টোবর ২০২৫। ঢাকা প্রেসক্লাবের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষকদের যেভাবে অপমান অপদস্থ করা হয়েছে, এটি রাষ্ট্রযন্ত্রকে উলঙ্গ করে ফেলেছে। প্রশাসনের যে ব্যক্তিটি শিক্ষকের গায়ে হাত দিল বা প্রশাসনের যে ব্যক্তিটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের ভিতর বসে থেকে বিভিন্ন কৌশলে শিক্ষকদের মানবিক দাবিগুলোকে প্রতিহত করার ফন্দি আটছে, এরা সবাই কোনো না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা লাভ করেছে, সার্টিফিকেট লাভ করেছে এবং চাকরি পেয়েছে। আর চাকরি পেয়েই শিক্ষককে কলার ধরে টানার সুযোগটা তারা হাতছাড়া করেনি। এ দায় আসলে কার?
৫ আগস্ট ২০২৪ এর আগের ঘটনা বিবেচনায় নাই নিলাম। আজকের এই সরকার গঠন করা হয়েছিল একটি সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন নিয়ে। অথচ এই সরকারের অধীনস্থ প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ শিক্ষকদের সাথে অমানবিক আচরণ করে প্রমাণ করে দিয়েছেন ৫ আগস্ট এর আগে এবং ৫ আগস্ট এর পরের বাংলাদেশে আর যত পরিবর্তনই হোক, স্বভাবগত এবং নিপীড়নমূলক আচরণের পরিবর্তন হয়নি।
একটি সাপ যখন শীতনিদ্রায় যায়, তখন তার আচার-আচরণ কিছুটা পরিবর্তিত হয়। ক্ষিপ্রতা কিছুটা কমে যায়, তবে বৈশিষ্ট্য সাপেরই থাকে। সুযোগ পেলেই ছোবল মারে। আর সেই ছোবল ক্ষিপ্রতার সাথে হোক বা না হোক, বিষ প্রয়োগে মৃত্যু ঠিকই ঘটাতে পারে!
পতিত সরকারের আমলে যে পুলিশ প্রশাসন বা সাধারণ প্রশাসন সাজানো হয়েছিল, তার সবটা প্রায় একই রকম আছে। উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজন দেশত্যাগের পরে বা উচ্চ পর্যায়ের কিছু মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পরে দেশের মানুষ যে আশ্বস্ত বোধ করেছিল সেটি যে ঠিক ছিল না-এটি নিশ্চিত। আওয়ামী সুবিধাভোগী প্রশাসন যন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীগুলো শীতনিদ্রায় রয়েছে! সুযোগ পেলেই ছোবল মারছে! এবং এরা স্বভাবগতভাবেই সমগ্র জীবন একই রকম থাকবে। এদের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য যেকোনো মূল্যে দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করা এবং তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা।
শিক্ষকেরা শ্রেণি কার্যক্রম বর্জন করায় মাধ্যমিক শিক্ষা যে বড় ক্ষতির সম্মুখে পড়তে যাচ্ছে এবং এর প্রভাব যে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থায় পড়বে, বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতির মুখে পড়লে প্রকৃতপক্ষে লাভবান কারা হবে তা চিন্তার বিষয়। দেশের ইতিহাসের সবচাইতে নামকরা শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ মানুষদের নিয়ে তৈরি করা এই উপদেষ্টা পরিষদ, যার শিক্ষা উপদেষ্টা ডঃ সি আর আবরার এর মত শিক্ষাবিদ এবং যার নেতৃত্বে রয়েছে ডঃ ইউনুস এর মত একজন আন্তর্জাতিক মানের চৌকস মানুষ- সেই উপদেষ্টা পরিষদ শিক্ষকদের মর্যাদা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না কেন বা কার জন্য বা কি উদ্দেশ্য নিয়ে, এটি জাতিকে নিশ্চিত ভাবে চিন্তায় ফেলে দেয়। ডঃ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে শিক্ষকদের পক্ষে কাজ করা শুরু করেছিলেন, এমনকি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি উৎসব ভাতা বৃদ্ধির আদেশটি তিনি দায়িত্ব ছাড়ার আগ মুহূর্তে স্বাক্ষর করে অগ্রায়ন করেছিলেন। এর পরেই হঠাৎ করে তাকে বদলি করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। এই প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত হয়ে হয়তো পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বিবিধ মঙ্গল সাধিত হয়েছে, তবে একটি সন্দেহ থেকেই যায় যে তাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষকদের পক্ষে কাজ করার সুযোগ না দেওয়ার জন্য ওই বদলি করা হয়েছিল কিনা! এই ধারণা আরও শক্তিশালী হয় যখন ১৮ অক্টোবর একটি প্রভাবশালী দৈনিকের বরাতে জানা যায় পরিকল্পনা উপদেষ্টা অভিযোগ করেছেন আমলারা বিভিন্ন বিষয়ে বা বিভিন্ন কাজে অসহযোগিতার মাধ্যমে সমস্যা তৈরি করছে!
তাহলে রাষ্ট্র এবং সরকার কি পরিকল্পিতভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদন্ড, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বঞ্চনার স্বীকার করছে, যাতে শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষতি করে অন্য কাউকে লাভবান করা যায়?
সময় এসেছে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার। সময় এসেছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বাঁচানোর আন্দোলন করার। সময় এসেছে দেশ বাঁচানোর। দেরি হয়ে গেলে হয়তো স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যেতে পারে আমাদের দেশ মাতৃকা!
লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিক ও কবি