সংবাদ ডেস্ক: আরবি ভাষা বর্তমান বিশ্বের সর্বাধিক প্রচলিত ভাষাগুলোর একটি। আরববিশ্বের ২২টি দেশ ছাড়াও পৃথিবীর অনেক দেশ আরবিকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে। কোরআন, হাদিস এবং মুসলিম মনীষী ও বিজ্ঞানীদের রচনার ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয় আরবি ভাষা। কয়েক হাজার বছর পার হলেও আরবি ভাষা আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে আছে আজ পর্যন্ত। ইসলামী শাসনামলের কীর্তি হিসেবে পৃথিবীর নানা প্রান্তের ভাষা, সভ্যতা ও ইতিহাস-ঐতিহ্যে আরবি ভাষার প্রভাব দৃশ্যমান।
ইউনেসকো ২০১২ সালে সর্বপ্রথম ১৮ ডিসেম্বরকে আরবি ভাষা দিবস হিসেবে নির্ধারণ করে। প্রায় চার দশক আগে ১৯৭৩ সালে ঠিক এই দিনেই ষষ্ঠ ভাষা হিসেবে আরবি ভাষা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা লাভ করে। ২০১৩ সালে ইউনেসকোর উপদেষ্টা পরিষদ আরবি সংস্কৃতি তুলে ধরার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী এই দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক অঙ্গসংগঠন ইউনেসকো অন্য দাপ্তরিক ভাষাগুলোর মতো (ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, চায়নিজ, রুশ) আরবি ভাষা উদ্যাপনের জন্য একটি দিন নির্ধারণ করেছে। দিনটি বিশ্বময় ‘আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস’ বলে পরিচিত। এই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো আরবি ভাষা ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখা। সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের মাধ্যমরূপে গড়ে তোলা। প্রতিবছরই দিনটি উদ্যাপন করতে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আরব রাষ্ট্র নানা অনুষ্ঠান ও বহুমুখী কার্যক্রম হাতে নেয়। বেশ জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশের মধ্য দিয়ে পালিত হয় দিবসটি।
এ উপলক্ষে সহস্র শতাব্দী ধরে এই ভাষায় চর্চিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিশ্বসভ্যতায় এই ভাষার অবদান, আরবি ভাষাভাষী বরেণ্য মনীষীদের জ্ঞানভাণ্ডার, সাহিত্য, কলা, সংস্কৃতি ও জ্ঞানের নানা শাখায় আরব ও ইসলামী সভ্যতার বৈপ্লবিক অবদান তুলে ধরা হয়। ইউরোপের রেনেসাঁ ও শিল্প বিপ্লবে আরবসভ্যতার প্রভাব দেখা যায়, যা পরবর্তী সময়ে মধ্যযুগের শেষে ইউরোপীয় মানস ও নেতৃত্বের বিকাশে বিরাট ভূমিকা রাখে।
আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবসের আরো একটি লক্ষ্য হলো এই ভাষাকে বিশ্বের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা। কারণ আরবি ভাষা হলো সেমিটিক ভাষাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও বহুল প্রচলিত। আরবি ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৫ কোটি। এ ছাড়া গোটা দুনিয়ার সব মুসলিম এই ভাষায় ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধান পালন করে। সাধারণত ইবাদত-বন্দেগি আরবি ভাষায়ই হয়। এমনকি প্রাচ্যের খিস্টানদের অনেক গির্জারও নির্ভরযোগ্য ভাষা হলো আরবি। আরবি ভাষায়ই ইহুদি ও খিস্টানদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় গ্রন্থ লেখা হয়েছে।
ইউনেসকো তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আরবি ভাষার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। ১৯৪৮ সালে গঠিত হওয়া ইউনেসকো তৃতীয় সম্মেলনে আরবি ভাষাকে ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চের পাশাপাশি আরবিকেও দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আরবি ভাষাভাষী অঞ্চলে ইউনেসকো কার্যক্রম পরিচালনার সুবিধার্থে এটিকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এ ছাড়া আরবি ভাষায় ইউনেসকোর সব অনুষ্ঠান, কার্যক্রম ও শিক্ষামূলক নানা প্রগ্রাম প্রচার করারও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১৯৬০ সালে জাতিসংঘের এক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে আরবি ভাষায় নানা প্রকাশনা প্রকাশ করা হবে। কারণ এতে খুব সহজেই আরবি ভাষাভাষী মানুষের কাছে সেবা পৌঁছানো যাবে। এভাবে আরবিতে ইউনেসকোর গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৬৬ সালে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সাধারণ পরিষদের সভা চলাকালে সব বক্তব্যই আরবিতে অনুবাদ করা হবে এবং আরবি বক্তব্যও অন্য ভাষায় অনূদিত হবে। এর ঠিক দুই বছর পর আরবি ভাষা জাতিসংঘের দাপ্তরিক নানা কাজে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব ফ্রান্সের দার্শনিক রিনাহ মাহের আন্তরিকতার কারণে তা সম্পন্ন হয়। এই পদক্ষেপ আরবি ভাষাকে জাতিসংঘের বিভিন্ন বক্তব্যের অনুবাদ ডকুমেন্টারি তৈরি থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি কাজে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। এবং ধীরে ধীরে আরবি ভাষা অন্যান্য দাপ্তরিক ভাষার মতো মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের এক মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৩ সালে আরব রাষ্ট্রগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রচেষ্টার ফলে আরবি ভাষা চূড়ান্তরূপে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এ ক্ষেত্রে সেনেগালের প্রেসিডেন্ট আমাদো মুখতারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়।
একবিংশ শতাব্দীতে আরবি ভাষা বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। বিজ্ঞানের নিত্যনতুন পরিভাষার যথার্থ অনুবাদ, বর্তমান সময়ের তথ্য-প্রযুক্তির নানা শব্দ নির্বাচন ইত্যাদি আরবি ভাষাবিজ্ঞানীদের বিপাকে ফেলে দেয়। প্রকৃতপক্ষে এটি কোনো মৌলিক সমস্যা নয়। কারণ আরবি ভাষার ব্যাপ্তি ও বিশালতা অবাক করার মতো। তাই আধুনিক বস্তুসামগ্রীর নাম দেওয়া তেমন কঠিন ব্যাপার নয়। যুগ যুগ ধরে সৃষ্টি হওয়া সমস্যার সমাধানে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন।
এ ছাড়া আরো সমস্যার মোকাবেলা করতে হচ্ছে। প্রশাসন, অর্থনীতি, শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে উপনিবেশের কারণে গেড়ে বসা পশ্চিমা ভাষার প্রভাব, আঞ্চলিক ভাষার প্রসার। উপনিবেশের আনুকূল্যে থাকা এক দল লোকের আঞ্চলিক ভাষানির্ভরতা বিশুদ্ধ আরবি ভাষার বিকাশ ও বিস্তার এবং ঐতিহাসিক মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে ফেরাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনুবাদশিল্পের দুর্বলতাও আরবি ভাষার পশ্চাৎপদতার একটি বড় কারণ। ইংরেজিতে লেখা তথ্য-প্রযুক্তি সংক্রান্ত কোনো বইয়ের অনুবাদ ফ্রেঞ্চ ভাষায় হতে সময় লাগে সর্বোচ্চ তিন বছর। কিন্তু আরবি ভাষায় অনূদিত হতে সময় লাগে প্রায় দুই যুগ। এ ছাড়া আধুনিক ডিজিটাল পদ্ধতিতে আরবি ভাষা এখনো অন্যান্য ভাষার তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে। আধুনিককালে আরবি ভাষার সমস্যা, বাধা-বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে সময়োপযোগী পদক্ষেপ এবং উন্নত মানের গবেষণার কোনো বিকল্প নেই।