মানব ইতিহাসে বহু মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছে, যারা সমাজ সংস্কার, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ন্যায়নীতি ও মানবকল্যাণে অবদান রেখেছেন। তবে এ পৃথিবী প্রকৃত অর্থে ধন্য হয়েছিল তখনই, যখন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর সর্বশেষ রাসুল হিসেবে পৃথিবীতে আগমন করেন। তার আগমন শুধু আরব উপদ্বীপ নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য রহমত হয়ে এসেছে। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া : ১০৭)
অতএব, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন ও কর্ম পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা, যা আলোচনায় রাখা প্রতিটি মুমিনের ঈমানি দায়িত্ব।
অজ্ঞতার যুগে মানবসমাজ
রাসুল (সা.)-এর আগমনের আগে পৃথিবী বিশেষ করে আরব সমাজ ছিল নৈতিক অধঃপতন ও অজ্ঞতার গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। তারা মূর্তি পূজা করত, কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দিত, নারী ছিল দুর্বল ও পদদলিত, গরিবদের ওপর চলত নির্যাতন। মদ্যপান, জুয়া, খুন-খারাবি ছিল সাধারণ ব্যাপার। মানবিক গুণাবলি ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ তখন বিলুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় আল্লাহতায়ালা মানবজাতির মুক্তির জন্য তার শেষ নবীকে পাঠান।
মহানবীর জন্ম
প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী, মহানবী (সা.) ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। এ বছরটিকে ইতিহাসে ‘আমুল ফিল’ বা হাতির বছর বলা হয়। তার জন্মের আগেই বাবা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন এবং অল্প বয়সে মা আমেনাও মৃত্যুবরণ করেন। ফলে তিনি এতিম অবস্থায় বড় হন। কিন্তু আল্লাহর বিশেষ রহমতে তিনি মানুষের মধ্যে সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, দয়া ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য খ্যাতি লাভ করেন। মানুষ তাকে আল-আমিন [বিশ্বস্ত] নামে ডাকতে শুরু করেন।
নবুওতের সূচনা
৪০ বছর বয়সে হেরা গুহায় ইবাদতের সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে জিবরাইল (আ.) প্রথম ওহি নিয়ে আগমন করেন। আল্লাহ বলেন, ‘পড়ো, তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা আলাক : ১) এভাবেই নবুওতের যাত্রা শুরু হয়। এরপর থেকে তিনি মানবসমাজকে অজ্ঞতা, কুসংস্কার, মূর্তিপূজা ও অন্যায় থেকে মুক্ত করে তাওহিদের আলোয় পরিচালিত করার মহান দায়িত্ব পান।
মহানবীর দাওয়াত ও সংগ্রাম
রাসুল (সা.) প্রথমে গোপনে এবং পরে প্রকাশ্যে মানুষকে আল্লাহর একত্ববাদে আহ্বান করেন। তিনি মানুষকে বলেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা বলো, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তবেই সফল হবে।’ এই দাওয়াতের কারণে কুরাইশরা তার ওপর এবং তার সাহাবিদের ওপর চরম নির্যাতন চালায়। তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়, সাহাবিদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। কিন্তু মহানবী (সা.) সব অন্যায়-অত্যাচার ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করেন এবং আল্লাহর পথে অটল থাকেন।
মদিনায় হিজরত ও ইসলামি সমাজ গঠন
মক্কার নির্যাতন সহ্য করা অসম্ভব হলে আল্লাহর নির্দেশে রাসুল (সা.) ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় হিজরত করেন। এটি ইসলামের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। মদিনায় পৌঁছে তিনি একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে মুসলিম ও অমুসলিম সবাই শান্তিতে বসবাস করতেন। তিনি মসজিদে নববি প্রতিষ্ঠা করেন, সংবিধান প্রণয়ন করেন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন।
মানবতার মুক্তিদাতা
রাসুল (সা.) শুধু ধর্মীয় নেতা ছিলেন না, তিনি একজন মহান মানবতাবাদী। তার বাণী ও আচরণে ফুটে উঠেছে সর্বোচ্চ নৈতিকতা। তিনি দাসপ্রথা বিলুপ্তির উদ্যোগ নেন, নারীদের সম্মান ও উত্তরাধিকার প্রদান করেন, এতিম-গরিবদের হক আদায় করেন। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহর মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ [সুরা আহজাব : ৩৩/২১]
তিনি যুদ্ধেও দয়া ও ন্যায়নীতি প্রদর্শন করতেন। নারীদের হত্যা, শিশু হত্যা, গাছ কাটা কিংবা নিরীহ প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ করেন।
বিশ্বসভ্যতায় নবীজির অবদান
মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা ও আদর্শ মানবসভ্যতার গতিপথ পরিবর্তন করেছে। তার দাওয়াতের মাধ্যমে মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞান, ন্যায়নীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির নবজাগরণে প্রবেশ করে। ইসলামি সভ্যতা চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যে বিশ্বকে সমৃদ্ধ করেছে। তার শিক্ষা পৃথিবীতে শান্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দিশা দিয়েছে।
কোরআন—মানবতার পথপ্রদর্শক
রাসুল (সা.)-এর সবচেয়ে বড় মুজিজা হলো আল-কোরআন, যা মানবজাতির জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। কোরআন শুধু একটি ধর্মগ্রন্থ নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান, যা মানুষের জীবনযাত্রার সব দিকের দিকনির্দেশনা দেয়। কোরআন মানুষকে জ্ঞানচর্চা, সত্যবাদিতা, ন্যায়বিচার, দয়া, সহনশীলতা ও আল্লাহভীতি শেখায়।
রাসুলের বিদায় ও শিক্ষা
রাসুল (সা.) ৬৩ বছর বয়সে ১১ হিজরি রবিউল আউয়াল মাসে ইন্তেকাল করেন। তার বিদায় হজে প্রদত্ত খুতবা মানবাধিকার ঘোষণার মতো। সেখানে তিনি বলেন, ‘তোমাদের জীবন, সম্পদ ও ইজ্জত তোমাদের কাছে পবিত্র। নারীকে সদয়ভাবে ব্যবহার করো। সুদ চিরতরে হারাম। মুসলমান একে অন্যের ভাই।’ তার এ শিক্ষা আজও সমান প্রাসঙ্গিক।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নেতা
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনে এই পৃথিবী সত্যিই ধন্য হয়েছে। তিনি মানবতার মুক্তিদাতা, বিশ্বশান্তির দূত ও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নেতা। তার জীবন শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সব মানুষের জন্য আলোকবর্তিকা। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমার জন্য রয়েছে এক মহান চরিত্র।’ [সুরা কলম : ৬৮/৪] অতএব, তার শিক্ষা অনুসরণ করেই দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা অর্জন সম্ভব।
লেখক : মুফতি উবায়দুল হক খান
মুহতামিম, জহিরুল উলুম মহিলা
মাদরাসা, গাজীপুর
সূত্র: আমার দেশ।