বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শনিবার রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আগামী সোমবার এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করবে সরকার।
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে যুমনার সামনে রাত ১১টায় এক ব্রিফিংয়ে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। এ সময় তিনি ‘উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতি’ সাংবাদিকদের পড়ে শোনান।
বিবৃতিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনালের বিচারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে। উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ সভায় সভাপতিত্ব করেন।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ব্যাপারে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক থেকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ জুলাই আন্দোলনের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে মতামত নেওয়া হয়। দলগুলোর সবাই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তে সম্মতি জানান।
গত কয়েকদিন ধরে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্ররা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে প্রথমে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান এবং পরে শাহাবাগে ব্লকেড করে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে এ আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সভা-সমাবেশ হয়। জুলাই আন্দোলনের পক্ষে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোও এ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। সর্বশেষ শনিবার রাতেই ছাত্ররা সরকারকে এ দাবিতে এক ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন।
এদিকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের খবরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে অবস্থানরত ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্ররা বিজয় মিছিল করেন।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে উপদেষ্টা পরিষদে সিদ্ধান্ত
উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে বলা হয়, শনিবার রাতে (১০ মে) অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের এক বিশেষ সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে।
এতে বলা হয়, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতাদের বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীন সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরিপত্র পরবর্তী কর্মদিবসে জারি করা হবে বলেও বিবৃতিতে জানানো হয়। বুদ্ধপূর্ণিমা উপলক্ষে আজ রোববার সরকারি ছুটি। এ হিসেবে আগামীকাল সোমবার এ প্রজ্ঞাপন জারি হবে।
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জুলাই ঘোষণাপত্র আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত করে প্রকাশ করার সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছে বলে বিবৃতিতে বলা হয়।
আওয়ামী লীগের ইতিহাস
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার টিকাটুলীর কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেন প্যালেসে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দলটির সভাপতি এবং শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে সাধারণ সম্পাদক শামসুল হককে ‘অসুস্থ’ দেখিতে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। গঠনের সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে মুসলিম শব্দটি যুক্ত থাকলেও পরবর্তীকালে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ নামকরণ করা হয়। পরবর্তীতে শেখ মুজিব একাধিকবার দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগকে প্রথম নিষিদ্ধ করে। এ ছাড়া বাকশাল গঠনের সময় শেখ মুজিব নিজেই তার দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেন। পরবর্তীতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করলে অন্যান্য দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগও রাজনীতি করার সুযোগ পায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব হত্যার পর আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে পড়ে। পরে ১৯৮১ সালে দলটির সিনিয়র নেতাদের বাদ দিয়ে ভারতে নির্বাসনে থাকা শেখ মুজিবের মেয়ে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করেন। সেই থেকে টানা ৪৪ বছর শেখ হাসিনা দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। দলের প্রভাবশালী ও ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে এই ৪৪ বছরে একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে তিনি দলকে একটি ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দলে পরিণত করেছেন।
সূত্র: আমার দেশ।