বাজারে মোটা চালের সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে চালের দাম বাড়াচ্ছেন। এতে বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ বিপাকে পড়েছে। সরবরাহ ও দাম বাড়া নিয়ে সৃষ্ট সংকটের দায় নিচ্ছে না কোনো পক্ষই। খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা দায় চাপাচ্ছেন মিল মালিকদের ওপর। তাঁরা বলছেন, মিল থেকে মোটা চালের সরবরাহ কমে যাওয়ায় মোকামগুলোতে সংকট তৈরি হয়েছে। আবার মিলাররা বলছেন ধানের সংকটের কথা। তাঁদের বক্তব্য, মোটা চালের ধান আবাদে কৃষকরা আগ্রহ হারিয়ে চিকন ধানে ঝুঁকে পড়ায় চাহিদা অনুযায়ী ধানের সরবরাহ মিলছে না।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, মাসখানেক আগেও স্বর্ণা, গুটি, ব্রি-২৯, ব্রি-২৮, লতা, পাইজামসহ সাত থেকে আট ধরনের চাল পাওয়া যেত ৪৫ টাকা কেজির মধ্যে। এর মধ্যে কয়েকটির দাম ছিল ৪০ থেকে ৪২ টাকার মধ্যে। করোনা পরিস্থিতিসহ নানা কারণে বৃদ্ধি পেয়েই চালের এই দাম দাঁড়িয়েছিল। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও দাম আরো বেড়েছে। খুচরা বাজারে ৪৫ টাকা কেজির নিচে কোনো চাল নেই। অনেক দোকানে মোটা চাল পাওয়াও যাচ্ছে না। বিক্রেতারা বলছেন, একাধিক পাইকারি বাজার ঘুরে মোটা চাল সংগ্রহ করতে হচ্ছে। দামও আগের তুলনায় অনেক বেশি। তার প্রভাব পড়ছে খুচরা বাজারে।
বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, গত মঙ্গলবার রাজধানীর বাবুবাজারে গুটি স্বর্ণার মতো মোটা চাল পাইকারিতে ৪৩ টাকা ও ব্রি-২৮ ৪৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। ১০ দিন আগেও স্বর্ণা পাইকারিতে ৪২ ও ব্রি-২৮ ৪৫ টাকা কেজি ছিল।
অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন রনি বলেন, বর্তমানে মোটা চালের সরবরাহ কমে গেছে। বাজারে অনেকেই দু-একটির বেশি আইটেম আনতে পারছে না। মিলাররা বলছেন, এবার মোটা ধান উৎপাদন হয়েছে কম। তাই ধান সংকটে তাঁরা চাহিদামতো চাল সরবরাহ করতে পারছেন না।’
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ—টিসিবির হিসাবে গত বছর একই সময়ে স্বর্ণা, ইরি, লতা, পাইজামসহ মোটা চালের দাম ছিল ২৮ থেকে ৪০ টাকা। তা বাজারে এখন ৪৪ থেকে ৫০ টাকা কেজি। সে হিসাবে এক বছরে এসব মোটা চালের দাম বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ।
খাদ্য মন্ত্রণালয় গত মঙ্গলবার চালকল মালিকদের নিয়ে বৈঠক করে মাঝারি ও সরু চালের পাইকারি মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। সে অনুযায়ী সরু মিনিকেট ৫১ টাকা ৫০ পয়সা ও মাঝারি চাল ৪৫ টাকা কেজি ধরা হয়। গতকাল বুধবার থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু দেশে চালের সবচেয়ে বড় দুই মোকাম নওগাঁ ও কুষ্টিয়ায় গত দুই দিনেও সেই সিদ্ধান্তের উল্লেখযোগ্য প্রতিফলন দেখা যায়নি। নওগাঁয় কয়েকটি চালকলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিলগেটে মাঝারি মানের চাল ৪৬ থেকে ৪৭ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অবশ্য সরু মিনিকেট চাল সরকারের বেঁধে দেওয়া দামেই বিক্রি করছেন মিলাররা।
কুষ্টিয়া জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিনের দাবি, বাজারে মোটা চালের ধানের সংকটেই চালের দাম বাড়ছে। মোটা চালে ভোক্তার আগ্রহ কমে যাওয়ায় চাষিরা এখন মোটা ধান কম আবাদ করছেন। সংকট দেখা দেওয়ায় বাসমতি, মিনিকেট, কাজল লতা ও স্বর্ণা ধানের দাম প্রতি মণে গড়ে ১০০ টাকা বেড়েছে। সে কারণে চালের দামও বেড়েছে। বর্তমানে বাজারে কোনো মোটা ধান নেই, যা ছিল তা সরকার কিনে নিয়েছে। বোরো না ওঠা পর্যন্ত বাজারে মোটা ধান পাওয়া যাবে না।
কুষ্টিয়ায় কাজল লতা ও আটাশ ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা এবং স্বর্ণা ৪২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগেও তা কেজিতে তিন টাকা কম ছিল।
মাত্র চার-পাঁচ দিন আগে বগুড়ার মোকামগুলোতে মোটা চাল কাটারি ৫০ কেজির প্রতি বস্তা ছিল দুই হাজার ১২০ টাকা। দাম বেড়ে এখন তা বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ২৫০ টাকা। এ ছাড়া মিনিকেট দুই হাজার ২০০ থেকে বেড়ে দুই হাজার ৩০০ টাকা ও গুটি স্বর্ণা এক হাজার ৯০০ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার টাকা বস্তা। অর্থাৎ প্রতি বস্তায় কাটারি ১৩০ টাকা এবং মিনিকেট ও গুটি স্বর্ণা ১০০ টাকা দাম বেড়েছে।
নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা চন্দন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতি মৌসুমে কৃষি বিভাগ যে উৎপাদনের কথা বলে, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। মোটা ধান উৎপাদনের বিষয়ে কৃষি বিভাগ যে ধারণা দেয় তার সঙ্গে বাস্তবের কোনো সামঞ্জস্য নেই। প্রকৃতপক্ষে মোটা ধান এখন আর আমাদের দেশের কৃষকরা তেমন উৎপাদন করেন না। কৃষি বিভাগের ওই ধারণার ওপর নির্ভর করে সরকার যখন মোটা চাল কিনতে চাচ্ছে তখন কৃষকের কাছে সেই ধান পাওয়া যাচ্ছে না।’
খাদ্যে উদ্বৃত্ত জয়পুরহাটে চাহিদা না থাকলেও ক্রমান্বয়ে চালের দাম বাড়ছে। বিশেষ করে প্রতি কেজি মোটা চাল এখন খুচরা ও পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকায়। আর পাইকারি বাজারে চিকন চাল ৪৮ টাকা কেজি হলেও খুচরা বাজারে তা ৫০ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ১০ দিনের ব্যবধানে এখানে প্রতি কেজি চালের দাম বেড়েছে তিন থেকে চার টাকা।