ব্যবসা-বাণিজ্য জীবিকা উপার্জনের একটি অন্যতম মাধ্যম। ব্যবসার মাধ্যমেই মূলত একজনের পণ্যসামগ্রী অন্যের কাছে পৌঁছে এবং মানুষের প্রয়োজন পুরো হয়।
সমাজের একটি বড় অংশ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী সততা ও আমানতদারির সঙ্গে মানুষের কল্যাণকামী হয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারলে সন্দেহাতীতভাবে ব্যবসাও ইবাদতে পরিণত হবে, ইনশাআল্লাহ।
১. সততা ও আমানতদারি : ব্যবসায় সততা ও আমানতদারি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যবসায়ীদের মধ্যে সততা ও আমানতদারি থাকলে বাজার অশান্ত হবে না, কৃত্রিম সংকট তৈরি হবে না এবং ক্রেতাও প্রতারিত হবে না। সবাই তৃপ্তি ও বিশ্বাসের সঙ্গে কেনাকাটা করতে পারবে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের উপার্জন শতভাগ হালাল ও বরকতময় হবে এবং পরকালে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের কাতারে দাঁড়ানোর সুযোগ হবে। আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী (কিয়ামতের দিন) নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১২০৯)
২. ইবাদতকে অগ্রাধিকার দেওয়া : ব্যবসা-বাণিজ্য আর অর্থের মোহে পড়ে আল্লাহকে ভুলে গেলে হবে না; বরং ইসলামের মৌলিক ইবাদত-বন্দেগি যেমন—নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত যথাসময়ে আদায় করতে হবে। ইবাদতের সময় ব্যবসা বন্ধ রেখে ইবাদতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাহলে অন্য সময়ের ব্যবসাও ইবাদত হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সেসব লোক যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে এবং নামাজ কায়েম ও জাকাত প্র্রদান থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেদিনকে, যেদিন বহু অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৩৭)
৩. হারাম ও নিষিদ্ধ পণ্যের কারবার বর্জন করা : যেসব পণ্য খাওয়া বা পান করা ইসলামে হারাম, দেহের জন্য ক্ষতিকর অথবা রাষ্ট্রের কল্যাণে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ, সেসবের কারবার বর্জন করতে হবে। যেমন—মদের কারবার, দেহ ব্যবসা, ভাগ্য নির্ণয়ের ব্যবসা ইত্যাদি হারাম ও নিষিদ্ধ। আবু মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) কুকুরের মূল্য, ব্যভিচারের বিনিময়, গণকের বকশিশ ভোগ করতে নিষেধ করেছেন। (বুখারি, হাদিস : ২১২২; মুসলিম, হাদিস : ৪০৯২)
৪. মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি না করা : ক্রেতাকে আশ্বস্ত করার জন্য মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রয় করা কোনোভাবেই সততার মধ্যে পড়ে না। মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রয়কারীর পরকালীন পরিণতি ভয়াবহ। আবু জার (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণির লোকের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেনও না এবং তাদের পবিত্র করবেন না। বরং তাদের জন্য রয়েছে ভয়ানক শাস্তি। তারা কারা, হে আল্লাহর রাসুল! তিনি বলেন, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, অনুগ্রহ করে খোঁটা দানকারী এবং মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রয়কারী। (মুসলিম, হাদিস : ৩০৬)
৫. পণ্যের ত্রুটি থাকলে তা প্রকাশ করে বিক্রি করা : পণ্য ক্রেতার সামনে খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করা বিক্রেতার দায়িত্ব। পণ্যের ছেঁড়া বা পচা অংশ না দেখিয়ে অথবা ভালোটি দেখিয়ে তার সঙ্গে খারাপগুলোও সরবরাহ করা নিশ্চিত প্রতারণা। নবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি পণ্যের ত্রুটি বর্ণনা না করে (বরং গোপন করে) বিক্রয় করে, সে সর্বদা আল্লাহর গজবের মধ্যে থাকে এবং ফেরেশতারা সব সময় তাকে অভিশাপ করতে থাকে। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৪৭)
৬. ভেজাল মিশিয়ে বা প্রতারণা করে বিক্রি না করা : ব্যবসায় আমানতদারির একটি অন্যতম দিক হলো কথা-কাজে মিল থাকা। পণ্যের যেমন গুণাবলি ও মান বলা হবে, বাস্তবেও তেমন থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে হেরফের প্রতারণার শামিল। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা রাসুল (সা.) খাদ্যশস্যের একটি স্তূপের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তিনি স্তূপের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিলেন, ফলে হাতের আঙুলগুলো ভিজে গেল। তিনি বলেন, হে স্তূপের মালিক! একি ব্যাপার? লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! এতে বৃষ্টির পানি পড়েছে। তিনি বলেন, সেগুলো তুমি স্তূপের ওপর রাখলে না কেন? তাহলে লোকেরা দেখে নিতে পারত। যে ধোঁকাবাজি করে সে আমার দলভুক্ত নয়। (মুসলিম, হাদিস : ২৯৫)
৭. সঠিক পরিমাপ নিশ্চিত করা : পণ্যের পরিমাপে কমবেশি করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সঠিক ওজন বা পরিমাপ নিশ্চিত করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘মন্দ পরিণাম তাদের যারা মাপে কম দেয়। যারা মানুষের কাছ থেকে মেপে নেওয়ার সময় পুরো মাত্রায় গ্রহণ করে এবং যখন তাদের জন্য মাপে অথবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।’
(সুরা : মুতাফফিফিন, আয়াত : ১-৩)
৮. মজুদদারি ও কৃত্রিম সংকট তৈরি না করা : অনেক সময় কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর মজুদদারির কারণে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়। এতে কিছু ব্যবসায়ী সাময়িক লাভবান হলেও মহামারি ও দারিদ্র্যের পথ খুলে যায়। রাসুল (সা.) বলেন, কেউ যদি মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আল্লাহ তাআলা তার ওপর মহামারি ও দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২১৫৫)
৯. স্বত্ব বা হস্তগত হওয়ায় আগে বিক্রি না করা : কোনো পণ্য নিজে মালিক না হয়ে বা নিজের আয়ত্তে আসার আগে বিক্রি করা যাবে না। কারণ এভাবে বিক্রি করে ক্রেতাকে হস্তান্তর করা সম্ভব নয়। হস্তান্তর করতে না পারলে বিক্রির কোনো অর্থ হয় না। নবী (সা.) বলেন, কোনো ব্যক্তি খাদ্যশস্য ক্রয় করলে সে যেন তা হস্তগত করার আগে বিক্রয় না করে। (বুখারি, হাদিস : ২০২৯)
১০. অনিশ্চিত কিছু বিক্রি না করা : ব্যবসায় এমন কোনো অবস্থায় সম্মুখীন হওয়া যাবে না, যাতে অনিশ্চয়তার আশঙ্কা থাকে। সরল মনে ও সরল পথে ব্যবসা করতে হবে। জটিলতা এড়িয়ে চলতে হবে। সবার স্বার্থ ও সুবিধা দেখতে হবে। এ জন্যই নবী (সা.) বিশেষ কিছু পদ্ধতির ক্রয়-বিক্রয় থেকে নিষেধ করেছেন। হাদিসে বলা হয়েছে, রাসুল (সা.) গবাদি পশুর গর্ভস্থ বাচ্চা প্রসবের আগে, পশুর স্তনের দুধ পরিমাপ না করে, পলাতক দাস, গনিমতের মাল বণ্টনের আগে, দান-খয়রাত হাতে আসার আগে এবং ডুবুরির বাজির (ডুব দিয়ে যা পাবে) ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২১৯৬)
পরিশেষে বলা যায়, ব্যবসায় উল্লিখিত ইসলামের নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়িত হলে ব্যবসায়ীদের উপার্জন হালাল ও বরকতময় হবে এবং ব্যবসায় কাটানো পুরো সময় ইবাদত হিসেবে পরিগণিত হবে। সেই সঙ্গে ক্রেতারা পাবে স্বস্তি ও প্রশান্তি।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
#DDN/মাহবুব-উল-আলম