আতাউর রহমান খসরু /
ইসলামের দৃষ্টিতে মানসিক সংকীর্ণতা একটি মানবিক দুর্বলতা ও ত্রুটি। যা মানবজীবনে নানাবিদ সংকট তৈরি করে এবং সুষ্ঠু স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধা প্রদান করে; এমনকি মানসিক সংকীর্ণতার কারণে মানুষ সত্যের দিশা থেকেও বঞ্চিত হয়ে যায়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ কাউকে সৎপথে পরিচালিত করতে চাইলে তিনি তার অন্তরকে ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দেন এবং কাউকে বিপথগামী করতে চাইলে তিনি তার অন্তরকে অতিশয় সংকীর্ণ করে দেন। ফলে তার কাছে ইসলাম অনুসরণ আকাশে আরোহণের মতোই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। যারা বিশ্বাস করে না আল্লাহ তাদের এভাবে লাঞ্ছিত করেন।’ (সুরা আনআম, আয়াত : ১২৫)
ইসলামের দৃষ্টিতে মানসিক সংকীর্ণতা
উল্লিখিত আয়াত থেকে স্পষ্ট হয় যে ইসলামের দৃষ্টিতে হৃদয়ের প্রশস্ততার অর্থ ঈমান ও ইসলাম গ্রহণে সক্ষম হওয়া এবং মানসিক সংকীর্ণতার অর্থ হলো ইসলামের সত্য-সুন্দর বাণী গ্রহণে ব্যর্থ হওয়া। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন মানবহৃদয়ে ঈমান প্রবেশ করে, তখন তা প্রসারিত হয় এবং প্রশস্ত হয়। সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), অন্তর প্রশস্ত হওয়ার কোনো নিদর্শন আছে কী? তিনি বলেন, হ্যাঁ। স্থায়ী আবাসের (পরকালে) প্রতি মনোযোগী হওয়া, প্রতারণার আবাসের (ইহকাল) প্রতি নিরাসক্ত হওয়া এবং মৃত্যুর আগে মৃত্যুর প্রস্তুতি গ্রহণ।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির : ৬/১৬৭)
মানসিক সংকীর্ণতা যেভাবে তৈরি হয়
আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখতা মানবহৃদয়ে সংকীর্ণতা তৈরি করে, ক্রমেই তার জীবনকে সংকীর্ণ করে তোলে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে আমার স্মরণে বিমুখ থাকবে, অবশ্যই তার জীবনযাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন উত্থিত করব অন্ধ অবস্থায়।’ (সুরা তাহা, আয়াত : ১২৪)
উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যা বিজ্ঞ আলেমরা বলেন, মানুষ যখন আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হয়, তাঁর আদেশ-নিষেধ উপেক্ষা করে, পাপাচারে লিপ্ত হয়, তখন আল্লাহ তার পার্থিব জীবনকে সংকটময় করে তোলেন।
মানসিক সংকীর্ণতার ক্ষতি
সত্য ও সুন্দর গ্রহণে যারা সংকীর্ণতা প্রদর্শন করে পার্থিব জীবনে তারা নানামুখী সংকটের মুখোমুখি হয়। যেমন—
১. অন্তরের কোমলতা বিনষ্ট : মানসিক সংকীর্ণতা মানব মনের কোমলতা নষ্ট করে। আল্লাহ বলেন, ‘যারা ঈমান আনে তাদের হৃদয় ভক্তি-বিগলিত হওয়ার সময় কি আসেনি, আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে? এবং আগে যাদের কিতাব দেওয়া হয়েছিল তাদের মতো যেন তারা না হয়—বহুকাল অতিক্রান্ত হয়ে গেলে যাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাদের বেশির ভাগ সত্যত্যাগী।’ (সুরা হাদিদ, আয়াত : ১৬)
২. দেহ-মনের অবসাদ : আল্লাহর স্মরণ ও আনুগত্য বিমুখ সংকীর্ণমনা মানুষ শারীরিক ও মানসিক অবসাদে ভোগে। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘পরিশুদ্ধ অন্তর মুমিনের শক্তির উৎস। যখন তার অন্তর শক্তিশালী হয়, তখন তার শরীরও শক্তিশালী হয়। পাপী ব্যক্তি যদিও শারীরিকভাবে শক্তিশালী হয়; কিন্তু প্রয়োজনের সময় সে শক্তি খুঁজে পায় না। কেননা তার শক্তি-সামর্থ্য তার সঙ্গে বেঈমানি করে যেমন সে নিজের সঙ্গে (আল্লাহর ব্যাপারে) করেছে।’ (আদ-দাউ ওয়াদ-দাওয়াউ, পৃষ্ঠা ১৩৬)
৩. জীবন ও সম্পদের অপচয় : সত্যবিমুখ সংকীর্ণমনা মানুষের জীবনে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও পরকালীন জবাবদিহির ভয় না থাকায় তারা তার জীবন ও সম্পদ অপচয় করে। ফলে তারা পার্থিব জীবনের কোনো এক পর্যায়ে এবং পরকালে আক্ষেপ করে বলবে—‘সে বলবে, হায়! আমার এ জীবনের জন্য আমি যদি কিছু অগ্রিম পাঠাতাম (সঞ্চয় করতাম)?’ (সুরা ফাজর, আয়াত : ২৪)
৪. মানুষের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়া : সংকীর্ণ মনের মানুষ যারা আল্লাহর আনুগত্য করে না, তাদের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো বান্দাকে যখন আল্লাহ তাআলা ঘৃণা করেন তখন জিবরাইলকে ডেকে বলেন, আমি অমুক ব্যক্তিকে ঘৃণা করি। অতএব তুমিও তাকে ঘৃণা কোরো। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আসমানবাসীর মধ্যে জিবরাইল তখন (এ কথা) ঘোষণা করেন। তারপর জমিনবাসীর অন্তরে তার জন্য ঘৃণা তৈরি হয়।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩১৬১)
৫. পরকালে নিঃস্ব হওয়া : সত্যগ্রহণে যারা সংকীর্ণতার পরিচয় দেবে পরকালে তারা নিঃস্ব হবে এবং বিপদের মুখোমুখি হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘…যারা আল্লাহর পথ থেকে ভ্রষ্ট হয় তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। কেননা তারা বিচার দিবসকে বিস্মৃত হয়েছে।’ (সুরা সাদ, আয়াত : ২৬)
মানসিক সংকীর্ণতা থেকে বাঁচার উপায়
আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান, তাদের আনুগত্যই মানুষকে মানসিক সংকীর্ণতা ও সংকট থেকে রক্ষা করতে পারে এবং তাকে দান করতে পারে উত্তম জীবন। ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিন পুরুষ ও নারী যেই ভালো কাজ করবে আমি অবশ্যই তাকে উত্তম জীবন দান করব এবং তাদের কাজের চেয়ে উত্তম প্রতিদান তাদের দেব।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৯৭)