1. admin@ddnnewsbd.com : admin : ddn newsbd
  2. mamahbubulalom@gmail.com : mahbubul alom : mahbubul alom
বুধবার, ০৪ জুন ২০২৫, ১২:৩৩ অপরাহ্ন

শিক্ষার আলো ছড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে নিজেই আলোকবর্তিকা হলেন শহীদ সিয়াম

ডিডিএন ডেস্ক:
  • আপডেটের সময় : শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫
  • ১৫ সময় দর্শন

হাফেজে কোরআন ও নিবেদিতপ্রাণ মাদ্রাসাছাত্র সিয়ামের ইসলামি শিক্ষার প্রতি ছিল গভীর ও অকৃত্রিম অনুরাগ—এ যেন ছিল তার হৃদয়-মন, চিন্তা-চেতনা ও স্বপ্নের মূলমন্ত্র। কিন্তু নিজ গ্রামে, তার বাড়ির আশেপাশে কোনো মাদ্রাসা না থাকায় তার অন্তরে জন্ম নেয় এক অভাববোধ, এক বেদনা—যা তাকে তাড়িয়ে বেড়াত সারাক্ষণ।

একসময় সেই বেদনাই রূপ নেয় এক অটল ও পবিত্র সংকল্পে—নিজ হাতে একটি মাদ্রাসা গড়ে তুলবেন তিনি, সমাজে ছড়িয়ে দেবেন ইসলামের আলো, জ্ঞানের আলো। যেখানে শিশুরা কোরআনের আলোয় আলোকিত হবে, গ্রামে ছড়িয়ে পড়বে ঐশী জ্ঞানের দীপ্তি, দূর হবে অজ্ঞানতার, অশিক্ষর অশুভ অন্ধকার।

তিনি সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়েও যান। এলাকাবাসীর কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে শুরু করেন স্বপ্নের মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার আন্তরিক
প্রচেষ্টা। জীবনের শেষ দিনেও তিনি সেই চেষ্টায় রত ছিলেন। ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট তিনি বাড়ি থেকে  মাদ্রাসার জন্য সাহায্য তুলতে বের হন—কিন্তু আর ফেরেননি।

দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিতে বন্ধুদের সঙ্গে যান এনায়েতপুর থানার সামনে। সেখানে আন্দোলন চলাকালে দুপুর ১ টার দিকে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন হাফেজ সিয়াম হোসেন।

তবে তার এই ‘না ফেরা’র গল্প শুধু এক ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়—এ এক জাতীয় ইতিহাসের অংশ। কেননা সময় তখন সংকটময়। দেশজুড়ে স্বৈরাচারের হিংস্র থাবা; গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানুষের অধিকার ভয়ানক বিপন্ন।

ঠিক এমন তখনই সময়ের দাবিতে তিনি সাড়া দেন এক বৃহৎ ও মহৎ দায়িত্বের ডাকে—স্বৈরাচার হঠানোর একদফা আন্দোলনে। সহযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে সময়ের গহীন থেকে ভেসে আসা এক অমোঘ আহ্বানে সাড়া দিয়ে সিয়াম বুকটান করে রাজপথে নেমে পড়েন জীবনবাজি রেখে, সত্যের পক্ষে।

সময় যখন ডাক দেয়, হৃদয়ের সবচেয়ে গোপন বাসনাও যেন সরে দাঁড়ায় ইতিহাসের প্রবল দাবির কাছে। তাই নিজের স্বপ্ন ছেড়ে, দেশের স্বপ্নকে আপন করে নিতে পিছপা হননি সিয়াম। স্বৈরাচার হঠানোর একদফা আন্দোলনের দামামা বেজে উঠেলে বিনা দ্বিধায় তিনি দেশমাতৃকার মুক্তিকে অগ্রাধিকার দেন। কারণ তিনি জানতেন—একটি মাদ্রাসা হাজারো শিক্ষার্থী গড়তে পারে, কিন্তু একটি মুক্ত দেশ গড়তে পারে লক্ষ-কোটি জনতার সোনালী ভবিষ্যৎ।

সহযোদ্ধাদের কাতারে দাঁড়িয়ে সিয়াম হয়ে ওঠেন সময়ের এক সাহসী সন্তান। যিনি স্বপ্ন দেখতেন আলো ছড়ানোর, সেই তিনিই হয়ে ওঠেন মুক্তির এক দেদীপ্যমান আলোকবর্তিকা। সমাজের অন্ধকারে আলো ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে স্বপ্নযাত্রার মাঝপথেই নিভে গেলেন স্বপ্নদ্রষ্টা নিজেই। তবু রেখে গেলেন এমন এক দীপ্তি, যা নিভে না গিয়ে সময়ের গভীরে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে—জ্বলবে সহস্র হৃদয়ে, অনন্তকাল।

সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার গোপরেখি দক্ষিণের বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস-এর প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এমন কথা জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ হাফেজ মো. সিয়াম হোসেনের মা লাকি খাতুন।

শহীদ মো. সিয়াম হোসেন ২০০৫ সালের ৪ মার্চের  সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুরের গোপরেখি দক্ষিণের গোমুখিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মো. কুদ্দুস আলী (৬০) ও মায়ের নাম মোছাম্মৎ লাকি খাতুন (৫০)।

শহীদ মো: সিয়াম এনায়েতপুর ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। ত্রিশপারা কোরআনের হাফেজ ছিলেন তিনি। খুব সুমধুর কন্ঠে কোরআনের তেলাওয়াত করতেন পারতেন। তার আজানের সুর ছিল খুবই চমৎকার। মাদ্রসায় পড়ালেখার পাশাপাশি একটি মসজিদে মোয়াজ্জিনের দায়িত্বও পালন করতেন তিনি।

দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সিয়াম ছিলেন সবার ছোট। বড় ভাই রাকিবুল হাসান পড়ালেখা শেষ করে রাজধানীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। বোন কণা পারভীন। এইএসসি পাস করার পর বিয়ে হয়ে গেছে তার।

মা লাকি খাতুন বলেন, এনায়েতপুর স্থানীয় মাদ্রাসা থেকে কোরআনের হাফেজ হয়ে মাওলানা হবার আশায় একই মাদ্রাসায় পড়ালেখা করছিল সিয়াম। পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য বেতিল বাজার এলাকায় নজরুল মুছা জামে মসজিদের মোয়াজ্জিনের দায়িত্বও পালন করত।

তিনি বলেন, ওর বাবার অনেক বয়স হয়েগেছে। কোন কাজ করতে পারেন না। বড় ভাই ঢাকায় একটা ছোট চাকরি করে। যা বেতন পায় তা দিয়ে আমাদের সংসার চলে না। তাই সিয়াম মসজিদের মোয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করে নিজের খরচ  চালাত এবং সংসার চালাতেও সহায্য করত।

তিনি বলেন, মাদ্রসার জন্য সাহায্য তুলে যাবার কথা বলে বাসা থেকে বের হয় ছেলে আমার। সেখান থেকে এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে সেদিনের আন্দোলনে অংশ নিতে এনায়েতপুর থানার সামনে যায়। পরে পুলিশ তাদের মিছিলের ওপর গুলি চালায়।

সেসময় একটি গুলি সিয়ামের মাথায় লাগে। সাথে সাথে সে মাটিতে পড়ে যায়। বন্ধুরা তাকে সাথে সাথে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য গাড়িতে তুললে সেখানেই শহীদ হয় সে।

তারপরেও বন্ধুরা স্থানীয় খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রতিকূল অবস্থায় তাকে ময়নাতদন্ত ছাড়াই রাত ১২ টার দিকে স্থানীয় আজুগড়া কবরস্থানে একই ঘটনায় আরেক শহীদ শিহাবের কবরের পাশে দাফন করা হয়।

শহীদ সিয়ামের প্রতিবেশী নজরুল ইসলাম বলেন, সিয়ামে মৃত্যুর ঘটনায় আমরা পুরো গ্রামবাসী অনেক কষ্ট পেয়েছি। সে খুব ভালো ছেলে ছিল। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলত। সিয়াম খুব সুন্দর করে আজান দিতে পারত, ভালো কোরআন তেলাওয়াত করতে পারত। তার কন্ঠ ছিল অনেক সুন্দর ।

সিয়ামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আম গাছে ঝুলানো তার ব্যায়ামের রিংগুলো, নিজ হাতে লাগানো ফুল গাছগুলো আর গোলাপ গাছে ফুটে থাকা কয়েকটি গোলাপ যেন তার কথা বারবার মনে করিয়ে দেয়। তার মা লাকি খাতুন সেই ফুলগাছেগুলোতে ফোটা ফুলগুলো দেখে দেখে হাতড়ে ফেরেন তার ছেলের হাজারো স্মৃতি।

শহীদের নানি রবি খাতুন বলেন, আমার নাতির মত ছেলে হয় না। সে খুবই নম্র-ভদ্র একজন ছেলে ছিল। সে ছোটদের ভালোবাসত, তাদের সাথে খেলত এবং বড়দের সম্মান ও শ্রদ্ধা করত।

তিনি বলেন, যেদিন সে আন্দোলনে যায়, আমরা ভাবতেও পারিনি যে তার এমন কিছু হবে। হঠাৎ একজন ফোন করে বলে সিয়ামের খবর নেন, ওর গুলি লেগেছে ও হাসপাতালে আছে। আমরা হাসপাতালে ছুটে যাই। গিয়ে তাকে মৃত অবস্থায় পাই। আমরা এই হত্যার বিচার চাই।

সিয়ামের বাবা আবদুল কুদ্দুস বলেন, আমার ছেলের অনেক কষ্ট করে লেখা পড়া করেছে। আমার কোন চাষাবাদের জমি নেই। বড় ছেলেকে লেখাপড়া করাতে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। বাড়িতে ঘর ছিল না, অনেক কষ্টে টিনশিটের একটি ঘর দিলাম আর ছোট ছেলেটা আমাদের ছেড়ে চলে গেলো!

তিনি বলেন, আমার ছেলেটার আশা ছিল একটি মাদ্রসা প্রতিষ্ঠা করার। তাই সরকারে কাছে আহ্বান জানাব সিয়ামের স্বপ্ন পূরণে যেন তার নামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়।

বড় ছেলেকে একটি সরকারি চাকরি দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে কুদ্দুস আলী বলেন, আমি ও সিয়ামের মা দুইজনই অসুস্থ। প্রতিমাসে দুইজনের কয়েক হাজার টাকার ওষুধ লাগে। আমরা কোনো কাজ করতে পারি না।আমাদের সংসার কিভাবে চলবে জানি না।

বড় ছেলে রাকিবুল হাসান টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সামান্য বেতনে চাকরি করে। তা দিয়ে আমাদের সংসার চলে না। তাই সরকার যদি বড় ছেলেটার জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিত তাহলে আমরা কোনোভাবে চলতে পারতাম।

সিয়াম হত্যার ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা করা হয়নি জানিয়ে মা লাকি খাতুন বলেন, আমার ছেলে কোরআনের হাফেজ ছিল। সে শহীদ হয়েছে। কে বা কারা এই হত্যাকাণ্ড করেছে আমরা তাদের দেখিনি। না জেনে মামলা দিয়ে কারো অভিশাপ নিতে চাই না। আমরা চাই না ময়নাতদন্তের জন্য আমার ছেলের লাশ কবর থেকে ওঠানো করা হোক।

আন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশার বিষয়ে তিনি জানান, যারা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন রাষ্ট্রীয়ভাবে সবাইকে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে। আমি চাই আমার বড় ছেলেটার জন্য সরকার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিক। এছাড়া শহীদ সিয়ামের ইচ্ছা অনুযায়ী সরকার যেন সিয়ামের নামে আমাদের এলাকায় একটি মাদ্রসা প্রতিষ্ঠা করে দেয়।

সহযোগিতার বিষয়ে সিয়ামের বাবা কুদ্দুস আলী বলেন, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক এবং জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা ছাড়াও বিএনপি ও এনসিপির পক্ষ্য থেকেও সহযোগিতা পেয়েছি। এছাড়া সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঈদের আগে আমাদের সঙ্গে দেখা করে কিছু ঈদসামগ্রী দিয়েছেন।

সূত্র: বাসস

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর
২০২০© এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ*
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Smart iT Host