1. admin@ddnnewsbd.com : admin : ddn newsbd
  2. mamahbubulalom@gmail.com : mahbubul alom : mahbubul alom
শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৩১ পূর্বাহ্ন

কবর ছুঁয়ে সন্তানের আহাজারি, ‘বাবা ওঠো, বাবা ওঠো’, বাবা যে জাগবে না আর

ডিডিএন ডেস্ক
  • আপডেটের সময় : রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
  • ৮ সময় দর্শন

শহিদ হওয়ার দিনও জোবায়ের বেপারী তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘দেখো, আজকেই হাসিনার শেষ দিন।’

তিনি সবসময়ই তাঁর স্ত্রীকে বলতেন, ‘স্বৈরাচার সরকার আমরা নামাবোই, নামায়াই ছাড়বো।’

ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। সেটাও দেখে যেতে পারেননি শহিদ জোবায়ের। তার আগে ১৯ জুলাই সন্ধ্যার ঠিক আগে গুলিতে প্রাণ হারান তিনি।

এদিকে ঠিক আগের দিন ১৮ই জুলাই উত্তরার বুকে যেন নেমে এসেছিল রোজ কিয়ামত। রাজধানী ঢাকার উত্তর প্রবেশ পথ উত্তরা। এ জনপদের মানুষ একদিনে এতো লাশ এর আগে দেখেনি কোনদিন।

মৃত্যুর এত বিভীষিকা দেখেও রাজপথের সংগ্রামীরা পিছু হটেননি। একটুও বিচলিত হননি। তারা আবার পরদিন শুক্রবার বারোটার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দখলে নেয়। আর এ আন্দোলনে একেবারে সামনের সারির নেতৃত্বে ছিলেন শহিদ মো. জোবায়ের বেপারী (৪২)।

মাত্র ২৩ বছর বয়সে বিধবা হওয়া শহীদের স্ত্রী চাঁদ মনি বলেন, ‘তিনি আজীবন প্রতিবাদী ছিলেন। আন্দোলন-সংগ্রামের ডাক আসলে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন। তারই ধারাবাহিকতায় এবারের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনেও পহেলা জুলাই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত উত্তরায় এবং ঢাকার রাজপথে সমানভাবে সক্রিয় ছিলেন। প্রতিদিন মিছিল মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করতেন এবং বাসায় এসে খুব উত্তেজিত হয়ে তার বর্ণনা দিতেন।’

শহিদের পিতা আব্দুস সবুর বেপারী (৭৬) ও মা আমেনা বেগম (৭০)। বার্ধক্যের নানান রোগে তারা আক্রান্ত। রাজধানী ঢাকার উত্তরখান থানাধীন দোবাদিয়া বেপারি পাড়ার স্থানীয় বাসিন্দা তাঁরা। তাঁদের সংসারে দুই ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে ছোট ছেলে ছিলেন জোবায়ের। বড় ভাই আবু কালাম বেপারী (৪৬) ব্যবসা করেন। চার বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। কিছুদিন আগে সিঙ্গাপুর থেকে উন্নত চিকিৎসা নিয়ে এসেছেন শহিদের পিতা। চিকিৎসাসহ সব কিছুতেই বাবার পাশে থাকতেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসস’র প্রতিনিধির কাছে তাঁর বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমাকে এখন ডাক্তারের কাছে কে নিয়ে যাবে? আমার হাতের ন্যাওটা [সার্বক্ষণিক সঙ্গী] ছিল আমার এই সন্তানটা। সাবেক এমপি কুখ্যাত হাবিব হাসান ও খসরু চৌধুরীর লোকেরা আমার ছেলেটাকে টার্গেট করে মেরেছে। আমার জমি-জমা নিয়ে হাবিব হাসানের লোকজন খুব জ্বালাতন করতো। এসব ব্যাপারে সবসময় ছেলেটা প্রতিবাদ করতো। এই প্রতিবাদটাই ওর জন্য কাল হলো। ও বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। সেচ্ছাসেবক দল করতো।’

খোঁজ নিয়ে ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, উত্তরার যে কোন আন্দোলন সংগ্রামকে সাবেক এমপি হাবিব হাসান এবং তার পুরো পরিবার নির্মমভাবে দমন করতো। তার ব্যতিক্রম হয়নি এবারের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনেও। হাবিব হাসানের ছেলে আবির হাসান তামিম এবং তার আপন ছোট ভাই আলাউদ্দিন সোহেল দলবল নিয়ে সাবেক এমপির নেতৃত্বে পুরো আন্দোলনের সময় বারবার অস্ত্র হাতে সরাসরি আক্রমণ চালিয়েছে। এ সংক্রান্ত বেশ কিছু ফুটেজ সাংবাদিকদের কাছে সংরক্ষিত আছে।

এ প্রসঙ্গে শহিদের মৃত্যুর সময় পাশে থাকা বস্ত্র প্রকৌশলী তালহা যুবায়ের সজিব (৩৫) বলেন, ‘১৯ জুলাই আমরা দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মিছিল-মিটিং নিয়ে উত্তরার রাজপথ দখলে রেখেছিলাম। সন্ধ্যার আগ দিয়ে পুলিশ ও সরকার দলীয় ক্যাডারদের ধাওয়া খেয়ে ৬ নম্বর সেক্টর বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের সামনে দিয়ে পূর্ব দিকে যাচ্ছিলাম। ওই দলে আমরা লোক ছিলাম ১০-১৫ জন। আমার পাশে ছিল শহিদ জোবায়ের। হঠাৎ করে কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই পেছন থেকে একটি গুলি তার পিঠ ভেদ করে সামনে দিয়ে বেরিয়ে যায়। সাথে সাথে সে উপুড় হয়ে পড়ে যায়। আমরা দেখি জায়গাটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। পশ্চিম দিক হতে পুলিশ এবং লীগের ছোঁড়া গুলিতে সে শহিদ হয়। পুলিশের অস্ত্র নিয়ে লীগের ছেলেরা গুলি করছিল। গুলিটা শুধু ওকে টার্গেট করে করা হয়েছে।’

ঐদিন ঘটনাস্থলে এ প্রতিবেদকসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহের কাজে ছিলাম। আমরা পরবর্তীতে হাসপাতালে গিয়ে তার গায়ে বিদ্ধ বুলেটের ছবি তুলি। চাইনিজ রাইফেলের বড় গুলি। সেই বুলেটের ছবি এখনো বাসস’র কাছে সংরক্ষিত আছে। ওই গুলিতে জোবায়ের সাথে সাথে মারা যায়।

জোবায়েরের সাত বছরের সংসারে দু’টি ফুটফুটে বাচ্চা রয়েছে। মৃত্যুর কিছুদিন পরই তাদের সপ্তম বিবাহ বার্ষিকী ছিল। বড় ছেলে জায়ান (৬) প্লে গ্রুপে এবং ছোট ছেলে রাইয়ান (৪) নার্সারিতে পড়ে। পিঠাপিঠি দুই ভাই ওরা এখনো বোঝে না ওদের বাবা আর নেই।

শহিদের স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ওরা বারবার আমার কাছে জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা কি আর আসবে না?’ ছোট ছেলে বাবার কবর ছুঁয়ে ডাকে, ‘বাবা ওঠো, বাবা ওঠো। আম্মু তোমার জন্য সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে।’

তিনি বলেন, আমার বাচ্চা দুইটা এই বয়সে এতিম হলো। আমার পুরো জীবনটা পড়ে আছে। কোনদিন কি কল্পনা করেছি, এই বয়সে আমি বিধবা হবো?

তিনি ওই দিনের স্মৃতিচারণ করে আরও বলেন, ‘বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে তাঁর সাথে শেষ কথা হয়। আমার ভাসুর আমাকে ফোন করে বলে যে, ও গুলি খেয়েছে। আগের দিন ১৮ই জুলাই তাঁর বন্ধুরা অনেকেই ছররা গুলি খেয়েছিল। তাই আমিও ভেবেছিলাম যে, তার হয়তোবা ছররা গুলি লেগেছে। এদিকে ঘরে বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি অসুস্থ। তাই তাঁদেরকে কোন কিছু বুঝতে দেইনি। আর আমরাও তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে যাইনি, পরে গিয়েছি। ওর বড় ভাই হাসপাতালের সবকিছু দেখাশোনা করেছে। আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি, ও মারা গেছে।’

শহিদের বাবা এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ও ব্যবসা করতো। সবশেষ গাড়ির ব্যবসায় অনেক লস করেছিল। টিকতে না পেরে একটা ভেকু কেনে। সেই ভেকু দিয়ে ব্যবসা করতেছিল। এর মধ্যে এত বড় একটা দুর্ঘটনা। আপনারাই বলেন, একে তো আমি অসুস্থ। সবকিছু স্মৃতিতেও থাকে না। এই বৃদ্ধ বয়সে বাবা হয়ে কেমনে সহ্য করি? বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ, এর চেয়ে ভারি তো আর কিছু হয় না। আমি আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই এবং এই বিচার মৃত্যুর পূর্বে দেখে যেতে চাই।’

কোন মামলা করেছেন কিনা? প্রশ্নের জবাবে শহিদের পিতা বলেন, ‘আমরা ১৮৬ জনকে আসামি করে কোর্টে মামলা করেছি।’

সরকারি বা বেসরকারি কোন সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা? জানতে চাইলে শহিদের স্ত্রী বলেন, ‘আমরা সরকারি কোন রকম সহযোগিতা এখন পর্যন্ত পাইনি। জামায়াতে ইসলামীর কাছ থেকে ২ লক্ষ টাকা এবং বিএনপি’র কাছ থেকে ১ লাখ টাকা পেয়েছি।’

উত্তরখান ঢাকার একদম শেষ মাথা এবং রাস্তাঘাটের বেহাল দশা। রাস্তার উন্নয়ন কাজ চলছে। হয়তো এ কারণে গণমাধ্যমের কাছে অনালোচিত আজকের শহিদ জোবায়ের। পরিবারের দাবি, ছোট ছোট দু’টি মাসুম বাচ্চার দায়িত্বটা যেন সরকার নেয়। অন্তত যেন খোঁজখবর করে। আর তাঁদের সন্তানটিকে যেন শহিদের মর্যাদা দেওয়া হয়।

বিষণ্ন মন নিয়ে গোধূলি বেলায় ফিরে আসছিলাম। হঠাৎ দেখলাম, শহিদ জোবায়েরের হাসিমাখা ছবি সম্বলিত একটি ব্যানার। এরকম বেশ কয়েকটি ব্যানার টাঙ্গিয়ে এলাকাবাসী তাদের প্রিয় সন্তানটির জন্য শোক প্রকাশ করছে।

জাতি কি পারবে তাদের এই সূর্য সন্তানদেরকে মনে রাখতে? যারা অকুতোভয় লড়ে দেশের জন্য জীবনটা বিলিয়ে গেছেন হাসিমুখে।

সূত্র: বাসস

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর
২০২০© এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ*
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Smart iT Host