২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নারীদের জন্য আসে ‘দ্য ডিফেন্ডার’। এটি মূলত স্মার্টফোনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া পিপার স্প্রেসহ নিরাপত্তার কিছু ফাংশন, যেখানে একটি বোতামে চাপ দিলে একদিকে যেমন মরিচের গুঁড়া বের হবে, তেমনি অল্প সময়ে গোপন ক্যামেরায় উঠে যাবে আক্রমণকারীর ছবি। আর থানায়ও পৌঁছে যাবে এই খবর।
এই উদ্ভাবনের খবর প্রকাশ পেলে ওই বছরের সেপ্টেম্বরেই নারীদের ওপর অপরাধ ঠেকাতে ভারতের কলকাতার পুলিশ ১২ দফা আচরণবিধি প্রকাশ করে, যার অন্যতম ছিল পিপার স্প্রে সঙ্গে রাখা। গত কয়েক বছরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গণপরিবহনে পিপার স্প্রে বহন, নারীদের জন্য অতি ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি, পুলিশের বিশেষ নিরাপত্তা অ্যাপ চালু, নারীদের জন্য আলাদা ট্যাক্সি সার্ভিস, লিপস্টিক গান তৈরিসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ধর্ষণ ও নারী নিপীড়ন ঠেকাতে উন্নত দেশগুলোতেও প্রতিরক্ষামূলক অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। চলছে নতুন নতুন উদ্ভাবন।
কিন্তু বাংলাদেশে ধর্ষণ, নিপীড়ন থেকে নারীদের সহায়তায় তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রায়ই গণপরিবহনসহ বিভিন্ন স্থানে ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা। সম্প্রতি সিলেটের এমসি কলেজে গৃহবধূ এবং খাগড়াছড়িতে এক প্রতিবন্ধীকে দলগত ধর্ষণের ঘটনায় তোলপাড় চলছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশ গত বছর একটিমাত্র বোতাম চেপে নারীদের সহায়তা পাওয়ার অ্যাপ চালুর কার্যক্রম গ্রহণ করে। সেই অ্যাপ এখনো উন্মুক্ত করা হয়নি। এখন আক্রান্ত হয়ে সুযোগ পেলে কেউ কেউ পুলিশের জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করে সহায়তা চাইছেন। ঢাকার আধুনিক ও সচেতন কিছু নারী ব্যাগে গোপনে পিপার স্প্রে রাখতেও শুরু করেছেন। এই স্প্রে ব্যবহারে পুলিশের স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, জরুরি সুরক্ষার সামগ্রী এবং ব্যবস্থা নারীদের মনোবল বাড়াবে। দ্রুত প্রতিরোধের কারণে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন কমবে। তবে ধর্ষণ ও নিপীড়ন প্রতিরোধে এই অপরাধের কঠোর শাস্তি কার্যকর করাই বেশি জরুরি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেনস অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নারীদের জন্য সব স্থান নিরাপদ করতে হবে। তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি দরকার ধর্ষক, লাঞ্ছনাকারীর কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা। আধুনিক অনেক নিরাপত্তা অ্যাপ বা উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলো কতটা কার্যকর হয় তা দেখতেও চালু এবং গবেষণা দরকার।’
২০১৪ সালে কলকাতায় পুলিশের ১২ দফায় পিপার স্প্রে অন্তর্ভুক্ত করায় বিতর্ক তৈরি হলেও এতে নারীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে। গত বছর হায়দরাবাদে এক প্রাণী চিকিৎসককে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটলে রাজ্যে মেট্রোতে নারীদের পিপার স্প্রে নিয়ে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়। বেঙ্গালুরুর মেট্রোতে আগেই পিপার স্প্রে বহনের অনুমতি দেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশে বাসে কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও কোনো নির্দেশনা দেখা যায়নি।
এখন গোপনে মেয়েদের জামা ব্লেড দিয়ে কেটে দেওয়া, গায়ে মরিচের পানি ও পানের পিক ছুড়ে মারার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হরতাল-অবরোধের দাঙ্গা দমন করতে পুলিশ পিপার স্প্রে ব্যবহার করে। এতে একটি মহল থেকে সমালোচনা করা হয়। ব্যক্তির নিরাপত্তায় এই স্প্রে ব্যবহারের ব্যাপারে পরিষ্কার কোনো নির্দেশনা নেই।
তবে নারী মানবাধিকার ও কর্মীদের সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় অনেকে অনলাইনে স্প্রে কিনে বাসায় রিফিল করে ব্যাগে রাখছেন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী তানজিনা মুনতাহা তাঁর ব্যাগে সব সময় পিপার স্প্রে রাখেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একবার বাসে আমার গায়ে হাত দেয় দুই যুবক। তখন কোনো প্রতিবাদ করতে পারিনি। এয়ারপোর্ট রোডে ঢাবির ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার পর পিপার স্প্রে ব্যাগে রাখছি। আমার মামা বিদেশ থেকে এনেছেন। অনলাইনে দেখে আমি রিফিল করা শিখে নিয়েছি।’
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেড় বছর আগে ইনোভেশন শাখা একটি বিশেষ অ্যাপ তৈরির কাজ শুরু করে। প্রথমে এর নাম ‘রোকেয়া’ রাখা হলেও পরে বদলে রাখা হয় ‘আশ্রয়’। অ্যাপটি উন্নত দেশের মতোই একটি বোতাম টিপে জরুরি সংকেত দিতে সক্ষম। যেকোনো স্থানে, যেকোনো সময় নারী বিপদে পড়লে একটি বোতাম টিপে সংকেত দিতে পারবে। এরপর পুলিশের প্রযুক্তি বিভাগের মাধ্যমে সবচেয়ে কাছে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা সাহায্য প্রার্থনাকারীর অবস্থান জেনে যাবেন এবং দ্রুত উদ্ধারের জন্য পাশে দাঁড়াবেন। ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের বাইরে (অফলাইন) থাকলেও এই সেবা নেওয়া যাবে। পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-ইনোভেশন) নেসারউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শিগগিরই আইজিপি স্যার অ্যাপটি দেখে চালুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন।’
এদিকে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে নারীরা ফোন করে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করছেন। প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের অভিযোগ করছেন অনেকে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা থানার অভয়তলা গ্রাম থেকে এক তরুণী ফোনে জানান, তিনি পুকুরে গোসল করতে যাওয়ার সময় একটি ছেলে তাঁকে জাপটে ধরে। তিনি ভয়ে চিৎকার শুরু করলে তাঁর স্বামী বেরিয়ে আসেন এবং তাঁরা দুজন মিলে অভিযুক্ত ছেলেটিকে আটকে রাখেন। পরে পুলিশ সেখানে গিয়ে রুবেল (১৮) নামের এক যুবককে আটক করে। ৯৯৯-এর দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ বলেন, ‘ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির অভিযোগেও দ্রুত স্থানীয় থানা পুলিশের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে ঘটনার পরই বেশি অভিযোগ মেলে।’
ধর্ষণ ঠেকাতে যত ব্যবস্থা
বিদেশি গণমাধ্যমের সূত্রে জানা গেছে, ভারতের বারানসির অশোক ইনস্টিটিউটে রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের গবেষক শ্যাম চৌরাসিয়া ‘স্মার্ট ঝুমকা’ তৈরি করেন, যার বোতামে চাপ দিলেই বেরিয়ে আসবে মরিচের গুঁড়ার বুলেট। ফোন চলে যাবে জরুরি নিরাপত্তা সেবার নম্বরে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের রুথ ও জুভাল নামের দুই নারী গবেষণা করে একটি অন্তর্বাস তৈরি করেন, যা বৈদ্যুতিক শক দিতে সক্ষম। ভারতের চেন্নাইয়ের এসআরএম বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন প্রকৌশলী তৈরি করেন বক্ষবন্ধনী। এগুলো পরিহিত কেউ আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে বার্তা চলে যাবে পুলিশ ও পরিবারের সদস্যদের কাছে। ভারতের কর্ণাটকের ফার্মাসিস্ট ইমরান খান আবিষ্কার করেন ‘স্ট্রিং বি সিলভার রিং’। এটি থেকে রাসায়নিক পুশ করলে দুর্বল হয়ে পড়বে আক্রমণকারী।
ঝুমকার পর ভারতের বিজ্ঞানী শ্যাম চৌরাসিয়া তৈরি করেন ‘লিপস্টিক গান’। এটি বিপদের সময় বড় বিস্ফোরণের শব্দ ঘটাতে পারবে এবং পুলিশকে জরুরি সংকেত পাঠানো যাবে। মেক্সিকোর চারজন শিক্ষার্থী মিলে ধর্ষণ প্রতিরোধে শক দিতে পারে, এমন জ্যাকেট উদ্ভাবন করেন। ভারতের হায়দরাবাদে ১৭ বছরের কিশোর সিদ্ধার্থ মণ্ডলা বানায় শক দেওয়ার বিশেষ জুতা ‘এলেকট্রো শু’। ২০১৪ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুরে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অস্ত্র কারখানা ইন্ডিয়ান অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি ‘নির্ভীক’ নামের ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করে। পয়েন্ট ৩২ ক্যালিবারের এই রিভলবার সহজে ছোট ব্যাগে রাখা যায়।
২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে দিল্লিতে চলন্ত বাসে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ২৩ বছর বয়সী মেডিক্যালের ছাত্রী ‘নির্ভয়া’র নামের সঙ্গে মিল রেখে আগ্নেয়াস্ত্রটির নাম রাখা হয়। নির্ভয়া অবশ্য ওই ছাত্রীর আসল নাম নয়, গণমাধ্যমে ব্যবহৃত ছদ্মনাম। ২০১৬ সালে ভারতের কেরালায় এক ট্যাক্সিচালকের দ্বারা নারী ধর্ষণের পর সেখানে নারীদের জন্য গোলাপি রঙের ‘শি-ট্যাক্সি’ চালু হয়। নারী চালক দিয়ে পরিচালিত ট্যাক্সিগুলোতে নিরাপত্তার জন্য ওয়্যারলেস ট্র্যাকিং গিয়ার, প্যানিক বাটন ও পিপার স্প্রে রাখা হয়।