বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের মূল ভিত্তি শোষিত-নিষ্পেষিত বাঙালির চূড়ান্ত মুক্তি। সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালির চেতনাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলে তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিরোধ আন্দোলনের ডাক দেন। ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সালে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (এখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ) ও তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে। ওই দিন ১০টায় আমি, জনাব শামসুল হক সাহেবসহ প্রায় ৭৫ জন ছাত্র গ্রেপ্তার হই এবং আবদুল ওয়াদুদসহ অনেকেই ভীষণভাবে আহত হয়ে গ্রেপ্তার হয়।’
শেখ হাসিনা সম্পাদিত ‘Secret Documents of Intelligence Branch on Father of the Nation BANGABANDHU SHEIKH MUJIBUR RAHMAN’ গ্রন্থ পাঠেও বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বায়ান্ন-পরবর্তী একুশের আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়া এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার নাম থেকে ‘বাংলা’ শব্দটি বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র করলে বাংলা ও বাঙালির প্রতি আত্মনিবেদনে উন্মুখ ও অবিচল বঙ্গবন্ধু প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে তিনি বলেন, “…ওরা পূর্ব বাংলা নামের পরিবর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে আপনারা এটাকে বাংলা নামে ডাকেন। ‘বাংলা’ শব্দটির একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য…।” সেই সময় থেকেই বাঙালির রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ও আন্দোলনে ‘পূর্ব বাংলা’ নামটি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উত্তুঙ্গ গতি পায়।
সামরিক ও আইয়ুব শাসক শেখ মুজিবুর রহমানের প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ করলে পাকিস্তানি শাসক ও শোষক বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি যে নতুন সংগঠন গড়ে তোলেন, সেই সংগঠনটির নামও দেওয়া হয় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’। ১৯৫৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খসড়া শাসনতন্ত্রের অন্তর্গত জাতীয় ভাষাসংক্রান্ত প্রশ্নে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, ‘পূর্ববঙ্গে আমরা সরকারি ভাষা বলতে রাষ্ট্রীয় ভাষা বুঝি না। কাজেই খসড়া শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের ভাষা সম্পর্কে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তা কুমতলবে করা হয়েছে।’ পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ৫৬ ভাগ লোকই বাংলা ভাষায় কথা বলে—এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোনো ধোঁকাবাজি করা যাবে না। পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবি এই যে বাংলাও রাষ্ট্রীয় ভাষা হোক।’ ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের অধিবেশনে রাষ্ট্রভাষা ও আঞ্চলিক বিষয়ক আলোচনায়ও বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
বাংলা ভাষার সূত্র ধরে বঙ্গবন্ধু এ দেশটির নাম দিয়েছেন বাংলাদেশ। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনাসভায় বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন, “একসময় এ দেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। …একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই।…জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি—আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’ এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।”
১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইত্তেফাক গ্রুপ অব পাবলিকেশন্সের সাংস্কৃতিক ও চলচ্চিত্র বিষয়ক সাপ্তাহিক পূর্বাণীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘জনগণের স্বার্থে এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য সাহিত্যিকদের প্রাণ খুলে আত্মনিয়োগ করার জন্য আমি আবেদন জানাচ্ছি। আমি তাদের আশ্বাস দিচ্ছি, কবি এবং সাহিত্যিকবৃন্দের সৃষ্টিশীল বিকাশের জন্য যেকোনো অন্তরায় আমি এবং আমার দল প্রতিহত করবে।’ ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘…স্বাধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে জাতীয় জীবনে ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব অপরিসীম।…আমি ঘোষণা করছি, আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল সরকারি অফিস-আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে।’
আজীবন বাংলা ও বাঙালিপ্রেমে উন্মুখ বঙ্গবন্ধু সেই কথা রেখেছেন। ‘দাবায়ে’সহ কিছু দেশি ও আঞ্চলিক শব্দকেও তিনি জনপ্রিয় করেছেন। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে তাঁকে কেউ ‘দাবায়ে’ রাখতে পারেনি। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি হিসেবে এক আদেশে তিনি বলেছেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি যে স্বাধীনতার তিন বছর পরেও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে—এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’
বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল। চাকরি, পদোন্নতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিচারে বাংলা ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল। চারদিকে বাংলা শেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর স্রোত বিপরীতমুখী হয়ে ওঠে—প্রতিক্রিয়াশীলতা তীব্র হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষা নির্বাসিত হতে থাকে। ‘বাংলাদেশ বেতার’, ‘চালনা বন্দর’, ‘পৌরসভা’, ‘রাষ্ট্রপতি’ প্রভৃতি ‘রেডিও বাংলাদেশ’, ‘পোর্ট অব চালনা’, ‘মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন’, ‘প্রেসিডেন্ট’ হয়ে উঠতে থাকে।
বাংলা ভাষা যেমন বাঙালি জাতিসত্তার মতো অমর, তৎপর, অবিনশ্বর, তেমনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বাংলা ভাষা, আন্দোলন ও বাঙালির মুক্তির গৌরবোজ্জ্বল দর্শন। এ ভাষায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং বাংলা ভাষার বিভিন্ন অর্জন বঙ্গবন্ধুকে গৌরবান্বিত করে, তেমনি বাংলা ভাষার বর্তমান বিশৃঙ্খল ও নির্বাসিত অবস্থা প্রকারান্তরে মুজিবীয় চেতনাকে আড়ষ্ট করে। তাই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা, বাঙালির প্রতি নিষ্ঠা, বঙ্গবন্ধুর চেতনার প্রতিই শ্রদ্ধা-ভালোবাসার প্রকাশ।