দেশের হাজার হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। ফলে মুখথুবড়ে পড়ছে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম। ভেঙে পড়েছে বিদ্যালয়গুলোতে শৃঙ্খলা কার্যক্রম। ব্যাহত হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষাদান। সহকারী শিক্ষকদের দিয়ে ওই বিদ্যালয়গুলো কোনোমতে চালিয়ে নেয়া হচ্ছে।
সারা দেশে ৬৫ হাজার ৫৬৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। নিয়োগ ও পদোন্নতি নীতিমালা অনুযায়ী ওসব বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৫ শতাংশ সরাসরি নিয়োগ ও ৬৫ শতাংশ পদোন্নতিযোগ্য প্রধান শিক্ষক পদ রয়েছে।
বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সরাসরি নিয়োগ হওয়া প্রায় ২০ হাজার প্রধান শিক্ষক রয়েছেন। কিন্তু বিগত ২০১৭ সালে চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত ১৮ হাজার প্রধান শিক্ষকের মধ্যে অনেকেই অবসরে চলে গেছেন। এখন ৩৪ হাজার ১০৬টি প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। মূলত মামলাজনিত ও আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে ২০০৯ সাল থেকে পদোন্নতি বন্ধ থাকায় পূরণ করা যাচ্ছে না প্রধান শিক্ষকের শূন্যপদ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদ পূরণে ৪৩তম বিসিএস থেকে ২৭৪ জনকে গত ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে নন-ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু মামলাজনিত জটিলতার কারণে ওই সুপারিশকৃতরা এখনো যোগদান করতে পারেননি। সমপ্রতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, নিয়োগযোগ্য ২ হাজার ৩৮২টি পদে সরাসরি নিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে সরকারি কর্ম কমিশনে (পিএসসি) চাহিদা প্রেরণ করা হয়েছে। শিগগিরই ওসব পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। তাছাড়া জাতীয়করণকৃত শিক্ষকদের গ্রেডেশন সংক্রান্ত সিভিল আপিল মামলা নিষ্পত্তি করে সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি যোগ্য ৩১ হাজার ৪৫৯টি পদ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হবে। ওসব নিয়োগ সম্পন্ন হলে উন্নত ও গতিশীল হবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম।
সূত্র জানায়, একটি প্রকল্পের শিক্ষকরা চাকরির শুরু থেকে তাদের সিনিয়রিটির জন্য ২০০৯ সালে আদালতে রিট দায়ের করেন। ওই পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাদের বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত পদোন্নতি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। আর তখন থেকেই বন্ধ রয়েছে সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি। ২০১৭ সালে সরকার ১৮ হাজার সহকারী শিক্ষককে প্রধান শিক্ষক পদে চলতি দায়িত্ব দেয়। কিন্তু তারপর নতুন করে জাতীয়করণ করা বিদ্যালয়ের ২৮৪ জন সহকারী শিক্ষক তাদের বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ সংরক্ষণ করার জন্য উচ্চ আদালতে রিট করেন। ওই রিটে দফায় দফায় স্থগিতাদেশের কারণে আটকে যায় পদোন্নতি। ২০২১ সালে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ী, লক্ষ্ণীপুর জেলার রায়পুরসহ কয়েকটি উপজেলায় পদোন্নতি চালু হয়। কিন্তু পরবর্তীতে মামলাজনিত কারণে ফের পদোন্নতি বন্ধ হয়ে যায়।
সূত্র আরো জানায়, পদোন্নতি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় শিক্ষকরা আগ্রহ হারাতে বসেছেন পাঠদান কার্যক্রমে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদেই অনেকের চাকরি শেষ হওয়ার পথে। অথচ নীতিমালা অনুযায়ী সাত বছরে শিক্ষকতা শেষে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির সুযোগ রয়েছে। কিন্তু মামলা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে ওই পদোন্নতি হচ্ছে না।
এদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানে অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়োগের নজির নেই। সেজন্য সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষকসহ সব পদে শতভাগ পদোন্নতি দেয়া হোক এবং তরুণ ও মেধাবীদের প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদানে উৎসাহিত করা হোক।
অন্যদিকে এ বিষয়ে প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজের সভাপতি শাহিনুর আল আমীন জানান, বিগত ২০০৯ সাল থেকে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতি বন্ধ রয়েছে। পদোন্নতি না থাকায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা। পরিস্থিতি বিবেচনায় মামলা জটিলতা শেষ করে দ্রুত পদোন্নতি দেয়া জরুরি।
সার্বিক বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান গতকাল জানান, আদালতে পেন্ডিং মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে ৩২ হাজার ৫০০ প্রধান শিক্ষকের পদে পদোন্নতি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। মামলা নিষ্পত্তি হলে সঙ্গে সঙ্গেই ওই পদগুলো পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা যাবে। আর সরাসরি প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ যোগ্য ২৩৮০টি পদ পূরণের জন্য পিএসসি শিগগিরই বিজ্ঞপ্তি জারি করবে।
সূত্র: এফএনএস।