ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় ২৫টি গরুর কাঁচা চামড়া বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ী তালুকদার খালেক। মোহাম্মদপুর এলাকা ঘুরে কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে চামড়া কিনেছেন তিনি।
সরকার নির্ধারিত দাম হিসাব করে চামড়া কিনেছিলেন খালেক। কিন্তু তার চেয়ে অনেক কম দাম পাওয়ায় হতাশ তিনি। সকাল সন্ধ্যাকে বললেন, “ভেবেছিলাম এবার চামড়া কিনে আড়তদারদের কাছে বিক্রি করে ভাল লাভ করব। কিন্তু সেই গতবারের মতো একই অবস্থা। লোকসানে বিক্রি করতে হলো।”
খালেক বলেন, “কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে এসব চামড়া ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে কিনে এনেছিলাম। কিন্তু কোনও আড়তদার বা ট্যানারি প্রতিষ্ঠান ৭৫০ টাকার ওপরে দাম দিতে চায় না। বাধ্য হয়ে ৭৫০ টাকা দরেই সব চামড়া বিক্রি করেছি। ভ্যান ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ হিসাব করলে বেশ ক্ষতিই হয়েছে আমার।”
ঈদের দিন শনিবার দুপুর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে চামড়া সংগ্রহ শুরু করেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বিক্রি করতে এসে প্রত্যাশিত দাম না পেয়ে খালেকের মতো হতাশ তারা।
এবার চামড়ার দাম পাঁচ টাকা বাড়ানো হলেও সরকার নির্ধারিত দরে কাঁচা চামড়া বিক্রি হচ্ছে না। গরুর চামড়ার দাম গতবারের তুলনায় একটু বেশি। তবে অন্য বছরগুলোর মতো এবারও ছাগলের চামড়া কিনতে অনীহা দেখিয়েছেন তারা।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর, সায়েন্সল্যাব ও পুরান ঢাকার পোস্তা এলাকা ঘুরে ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, এ বছর বেশির ভাগ গরুর কাঁচা চামড়া ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ৮৫০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে। ছোট চামড়ার দাম ৬০০ টাকা পর্যন্ত উঠছে। গত বছর রাজধানীতে গরুর কাঁচা চামড়ার দাম ৬০০ থেকে ৭৫০ টাকার মধ্যে ছিল। ছোট চামড়ার দাম ছিল ৫০০ টাকা।
এ ছাড়া এবার ছাগলের চামড়া প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে ১০ টাকা, যা গতবারও একই রকম ছিল। অনেকে কোনও দাম না নিয়েই মৌসুমী ব্যবসায়ী বা এতিমখানার লোকজনকে দিয়ে দিয়েছেন।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, এ বছর কোরবানির পশুর চাহিদা প্রায় ১ কোটি ৩ লাখ ৮০ হাজার। সেখানে গরু-ছাগলসহ কোরবানির জন্য প্রস্তুত ছিল প্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার পশু।
চলতি বছর কোরবানি ঈদের মৌসুমে ৮০ থেকে ৮৫ লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন ট্যানারিমালিকেরা।
ঢাকা শহরের ভেতরের বেশির ভাগ চামড়া আসে সায়েন্স ল্যাব এলাকায়। দুপুর ১২টার পর থেকেই এখানে কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে আসতে শুরু করেন বিক্রেতা ও ফড়িয়ারা। এখান থেকে চামড়া যায় পোস্তা কিংবা সাভারের চামড়া শিল্পনগরীর আড়তগুলোতে।
গত ২৬ মে কোরবানির পশুর চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। ঢাকার বাইরের গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা।
ঢাকায় সর্বনিম্ন কাঁচা চামড়ার দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। আর ঢাকার বাইরে সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ১৫০ টাকা। এ ছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়া ২২ থেকে ২৭ টাকা ও বকরির চামড়া ২০-২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তার আড়তগুলো কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের অন্যতম বড় জায়গা। শনিবার সন্ধ্যার দিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রিকশা, ভ্যান ও ট্রাকে করে মৌসুমি ব্যবসায়ী ও মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্ররা চামড়া নিয়ে আসছেন। আড়তদারেরা দরদাম করে চামড়া কিনছেন। এ ছাড়া পাইকারি ব্যবসায়ীরা সড়কের ওপর চেয়ার নিয়ে বসে চামড়া কিনছেন।
একাধিক আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ী জানান, একেকটি গরুর চামড়া ৭০০ থেকে ৮৫০ টাকায় কিনছেন। মাঝারি আকারের গরু কোরবানি হয় বেশি। সেই চামড়া তারা কিনছেন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে। ছোট গরুর চামড়া কিনছেন ৫০০ টাকায়।
পোস্তায় রেজাউল করিম নামের একজন ব্যবসায়ী কিনেছেন শতাধিক চামড়া। জানতে চাইলে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা না বুঝে বেশি দামে চামড়া কিনে নিয়ে আসেন। তবে বাজার ভালো নয়। তিনি জানান, ৭০০ থেকে ৮৫০ টাকায় চামড়া কিনছেন তারা।
আরেক ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম বলেন, “আমরা খাশি ও বকরির চামড়া কিনছি না। এ চামড়ার কোনও চাহিদা নেই।” তিনি জানান, প্রতিটি গরুর চামড়া ৭০০ থেকে ৮৫০ টাকায় কিনছেন।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, একেকটি চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে লবণ ও শ্রমিকের মজুরি বাবদ খরচ পড়ে যাবে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা।
মোহাম্মদপুর টাউন হল এলাকা থেকে চামড়া ক্রয় করেন মৌসুমি ব্যবসায়ী শেখ বাবুল। তিনি বলেন, ১০০টির বেশি চামড়া কিনেছেন। প্রতিটি চামড়া গড়ে ৭৫০ টাকা পড়েছে। সেই চামড়া বিক্রির জন্য সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় নিয়ে আসেন বাবুল। ৭৫০ টাকার বেশি কেউ দাম বলছে না। সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই চামড়া তিনি বিক্রি করেননি।
রাজধানীর কলাবাগান এলাকা থেকে গরুর ৩০টি কাঁচা চামড়া বিক্রির জন্য সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় নিয়ে আসেন মৌসুমি ব্যবসায়ী দিদার। কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে এসব চামড়া তিনি ৬০০ থেকে ৭৫০ টাকা দরে কিনে আনেন এবং বিক্রির জন্য দাম হাঁকেন ১ হাজার ২০০ টাকা করে। কিন্তু কোনও আড়তদার বা ট্যানারি প্রতিষ্ঠান ৭৫০ টাকার ওপরে দাম দিতে চায়নি। শেষ পর্যন্ত ৭৫০ টাকা দরেই সবগুলো চামড়া বিক্রি করেন তিনি।
দিদার বলেন, “যে আকারের চামড়া বিক্রির জন্য তিনি নিয়ে এসেছিলেন, সেগুলোর দাম হওয়া উচিত অন্তত ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা। কিন্তু একপ্রকার লোকসান করেই চামড়া বিক্রি করতে হলো। সারা দিনের ভ্যান ভাড়া ও একজন সহকারীর মজুরি দিয়ে তার কাছে আর কিছু থাকবে না।”
সায়েন্স ল্যাব এলাকাতেই মৌসুমি বিক্রেতাদের কাছ থেকে চামড়া কিনে রাখছিলেন আমিন ট্যানারি লিমিটেডের পরিচালক আব্দুল কাদের। চলতি বছর এই ট্যানারিটির এক লাখের বেশি লবণযুক্ত চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য আছে। কোরবানি ঈদের দুই দিনে তারা অন্তত ৪০ হাজারের মতো কাচা চামড়া সংগ্রহ করবে।
কাদের জানান, মৌসুমি বিক্রেতাদের কাছ থেকে ৭৫০ থেকে ৮৫০ টাকার মধ্যে বেশির ভাগ গরুর চামড়া কিনেছেন।
তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় প্রতিটি গরুর চামড়া ৭০ থেকে ১০০ টাকা বাড়তি দামে তারা কিনেছেন।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সিনিয়র চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এ বছর ছোট গরুর চামড়া বেশি। দামও গতবারের থেকে বেশি। সার্বিকভাবে চামড়ার সরবরাহ ভালো।”
তিনি জানান, গত বছরের তুলনায় প্রতিটি চামড়ায় দাম ১০০ টাকার মতো বেশি। চলতি বছর ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো পাঁচ থেকে ছয় লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়েছে। মূলত কাঁচা চামড়ার দাম তথা বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি কাঁচা চামড়া কিনে থাকে।
আড়তদাররা চামড়া সংগ্রহ করে লবণ মিশিয়ে তা সংরক্ষণ করেন। পরে লবণ মেশানো চামড়া যায় ট্যানারিগুলোতে।
এবার রপ্তানি ভালো
৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের ১১ মাসে অর্থাৎ জুলাই থেকে মে সময়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ১০৫ কোটি ৭৮ লাখ ২০ হাজার (১ দশমিক ০৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন এ খাতের রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত অর্থ বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি।
২০২৩-২৪ অর্থ বছরের একই সময়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ৯৩ কোটি ৯৮ লাখ ৭০ হাজার ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ।
২০২৩-২৪ অর্থ বছরের পুরো সময়ে (১২ মাস, ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন) চামড়া-চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে ১০৩ কোটি ৯১ লাখ ৫০ হাজার (১ দশমিক ০৪ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছে। যা আগের অর্থ বছরের চেয়ে ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ কম।
২০২২-২৩ অর্থ বছরের এই খাত থেকে ১১৭ কোটি ৫৪ লাখ ৬০ হাজার (১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছিল।
সূত্র: সকাল সন্ধ্যা