সংবিধান ও রাষ্ট্র পরিচালনায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার নিশ্চিত করতে আগামী সপ্তাহে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ফের আলোচনায় বসতে যাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। জুলাই সনদকে আইনি ও নীতিগত কাঠামোয় রূপ দিতে এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণই হবে আলোচনার মূল বিষয়। এর আগে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর অগ্রগতি জানাতেই শুক্রবার (৮ আগস্ট) জাতীয় সংসদের এলডি হলে সংবাদ সম্মেলন করে কমিশন।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, তৃতীয় পর্যায়ের সংলাপের আগে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে বাস্তবায়নের রূপরেখা নির্ধারণ করা হবে। এরপর সংশ্লিষ্ট দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষে সনদে স্বাক্ষর নেওয়ার মধ্য দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’।
আলী রীয়াজ বলেন, “ঐকমত্যের ভিত্তিতে রচিত সনদের বাধ্যবাধকতা এবং তা বাস্তবায়নের পথ রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে আশা করি।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে পাঁচটির সুপারিশ নিয়ে শুরু হয় আলোচনা। পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ সরাসরি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়নযোগ্য বিবেচনায় বাদ রাখা হয়।
দুই ধাপে ৮২ প্রস্তাবে ঐকমত্য
প্রথম পর্যায়ে সংবিধান, নির্বাচন, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশনবিষয়ক ১৬৬টি সুপারিশ রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর কাছে পাঠানো হয়। ৩৫টি দল মতামত দেয় এবং ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৩২টি দলের সঙ্গে ৪৪টি বৈঠক হয়। আলোচনার এই ধাপে ৬২টি বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য গঠিত হয়।
দ্বিতীয় পর্বে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ২০টি সাংবিধানিক বিষয় নিয়ে ৩ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত আলোচনায় বসে কমিশন। এতে ১১টি বিষয়ে সর্বসম্মত ঐকমত্য হয় এবং ৯টি বিষয়ে ভিন্নমতসহ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বিনা ভিন্নমতে গৃহীত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে:
• সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব
• নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ
• রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সংক্রান্ত বিধান
• বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ
• জরুরি অবস্থা জারির বিধান
• প্রধান বিচারপতির নিয়োগ
• সংবিধান সংশোধন
• প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল সীমিতকরণ
• নির্বাচন কমিশন গঠন পদ্ধতি
• স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন
• নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ
অন্যদিকে, যেসব বিষয়ে কোনো কোনো দলের ভিন্নমত রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে:
• সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন
• প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকা
• সরকারি কর্ম কমিশনসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক নিয়োগ
• সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব
• দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ
• রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি
• তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা
• রাষ্ট্রের মূলনীতি ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ
তৃতীয় পর্বের প্রস্তুতি ও বাকি কমিশনের আবেদন
গত ৩ আগস্ট সংসদ ভবনে কমিশনের সদস্যদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ভিন্নমত ছাড়া গৃহীত প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন ও সনদে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে নেওয়া হবে।
এদিকে, দ্বিতীয় দফায় গঠিত শ্রম, নারী, গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকারবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ এখনো আলোচনায় আসেনি। এই পাঁচ কমিশনের প্রধানরা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যেন তাঁদের সুপারিশগুলোও জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তাঁরা মনে করছেন, গণঅভ্যুত্থানে প্রাণ হারানো শ্রমিক, নারী ও সাংবাদিকদের স্বপ্ন ও দাবি বাস্তবায়নের এই সুযোগ হাতছাড়া হলে ভবিষ্যতে তা উপেক্ষিত হয়ে পড়বে এবং জনমনে হতাশা তৈরি করবে।
কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং সহসভাপতি আলী রীয়াজের নেতৃত্বে এই মুহূর্তে কমিশন দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য এক ঐতিহাসিক সনদের পথে এগোচ্ছে। তৃতীয় পর্বে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরের মাধ্যমে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ পাবে পূর্ণাঙ্গ রূপ—এমনই প্রত্যাশা দেশজুড়ে।
সূত্র: এফএনএস।