রবিবার , ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল || ১০ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

পর্যটনশিল্পে মুসলিম পুরাকীর্তির অমিত সম্ভাবনা

প্রকাশিত হয়েছে- মঙ্গলবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২০

পর্যটন বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময়ী খাত। বর্তমানে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে আয় প্রায় ৭৬ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ডলার। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২০ সাল নাগাদ পর্যটনশিল্প থেকে প্রতিবছর দুই ট্রিলিয়ন ডলার আয় হবে। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৫১টি দেশের পর্যটকরা বাংলাদেশে ভ্রমণ করবে, যা মোট জিডিপির ১০ শতাংশ অবদান রাখবে। (কলাম : পর্যটনের উন্নয়নে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৯ জানুয়ারি ২০২০) পর্যটন খাতের এ বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বিশেষ অবদান রাখতে পারে বাংলাদেশের মুসলিম স্থাপত্য ও পুরাকীর্তিগুলো।

বাংলাদেশে মুসলিম স্থাপত্যের সূচনা ও বিকাশ

বাংলাদেশে মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের সূচনা ও বিকাশ সম্পর্কে এ টি এম রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বাংলা বিজয়ের মাধ্যমে এ দেশে মুসলিম শাসন যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়, তেমনি সংস্কৃতির বৃহত্তর পরিমণ্ডলে এ দেশের স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাসে মুসলিম স্থাপত্যের সূচনা হয়। ১২৯৮ খ্রিস্টাব্দে ত্রিবেণীতে জাফর খান গাজীর মসজিদ নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলিম স্থাপত্যের যে সূচনা হয়েছিল ইলিয়াস শাহীর আমলে (১৩৪২-১৪১৫ খ্রি.) তা চরম শিখরে উন্নীত হয় এবং হোসেন শাহী আমলে (১৪৯৩-১৫৩৮ খ্রি.) আরো গতি সঞ্চারিত হয়ে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এমনকি আসাম ও বিহারেও। … ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ খান কররানির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় মোগল শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে এ দেশের স্থাপত্যকলায় এক নতুন মাত্রার সংযোজন ঘটে। সুলতানি আমলে দেশজ উপাদানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা স্থাপত্যকলার নির্মাণশৈলী ও আলংকারিক রীতি-নীতি মোগলদের নিকট সম্পূর্ণরূপে গ্রহণযোগ্য না হলেও তা একেবারে বর্জিতও হয়নি। বরং কিছু পরিবর্তন ও কিছু নতুন সংযোজনের মাধ্যমে বাংলার মুসলিম স্থাপত্য আরো পরিপূর্ণতা অর্জন করে।’ (প্রবন্ধ : বাংলার দুটি অনালোচিত মোগল মসজিদ, আইবিএস জার্নাল, ষোড়শ সংখ্যা ১৪১৫)

বাংলাদেশের মুসলিম স্থাপত্য

বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী বাংলাদেশে সরকারিভাবে সংরক্ষিত পুরাকীর্তির সংখ্যা মোট ৫১৮। এর মধ্যে মুসলিম পুরাকীর্তির সংখ্যা ২১৪। ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ৬৩টি মুসলিম পুরাকীর্তি এবং সিলেট বিভাগে সর্বনিম্ন পাঁচটি মুসলিম পুরাকীর্তি রয়েছে। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মুসলিম পুরাকীর্তি হলো, ‘ষাট গম্বুজ মসজিদ ও খান জাহান আলীর দরগা, আতিয়া মসজিদ, বাঘা মসজিদ, লালবাগ দুর্গ, তারা মসজিদ, ছোট সোনা মসজিদ, পানাম নগরী, কুসুম্বা মসজিদ, বিবি বেগনী মসজিদ, বিনত বিবির মসজিদ, জলদুর্গ ইত্যাদি। এর মধ্যে বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ ইউনেসকো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে।

তবে গবেষকরা মনে করেন বাংলাদেশের মুসলিম পুরাকীর্তির খুব সামান্যসংখ্যকই সংরক্ষিত হয়েছে।

ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘মুসলিম আমলে বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যে অসংখ্য ইমারত নির্মিত হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা ও গুরুত্ব আজ পর্যন্ত নির্ণয় করতে পারেনি বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।’ (বিশ্বের সেরা মুসলিম স্থাপত্যকীর্তি, পৃষ্ঠা ১৭২)

 

বাংলাদেশের পর্যটনে মুসলিম পুরাকীর্তির গুরুত্ব

বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের বিকাশে মুসলিম পুরাকীর্তি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। নানা কারণেই তা পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে। যেমন—

ক. সাংস্কৃতিক গুরুত্ব : বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের মুসলিম স্থাপত্যগুলোর সাংস্কৃতিক মূল্য অপরিসীম। কেননা তা প্রাক-ইসলামী স্থানীয় স্থাপত্যরীতির সঙ্গে আরব, পার্সিয়ান ও তুর্কির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল। ‘The Islamic heritage of Bengal’ শীর্ষক প্রবন্ধ সংকলনে সৈয়দ মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘মুসলিম বিজয়ের ঢেউ এখানে শৈল্পিক ঐতিহ্যের নান্দনিক সম্পদ গড়ে তুলতে উৎসাহিত করে। যা আরব, পার্সিয়ান ও মধ্য এশিয়ার (তুর্কি) দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তারা তা করেছিল অভিজ্ঞতার ব্যবহার ও স্থানীয় পুরাতন উপাদান আত্মস্থকরণের মাধ্যমে।’ Classification of mosques according to ground plan)

আর জর্জ মিশেল বাংলার মুসলিম স্থাপত্যকে বিদেশি ও স্থানীয় স্থাপত্যরীতির সমন্বয়ের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

 

খ. ঐতিহাসিক গুরুত্ব : প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রাচীন সমাজ ও সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। বখতিয়ার খলজি বাংলা বিজয়ের পর নানা পর্বে দেশি ও ভিনদেশি মুসলিম শাসকরা সাত শ বছর বাংলাদেশ শাসন করেছে। দীর্ঘ এই সময়ে নির্মিত স্থাপত্য ও পুরাকীর্তিগুলো সময়ের সাক্ষী হিসেবে বিশেষ ঐতিহাসিক মূল্য ধারণ করে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক বলেন, ‘দীর্ঘ মুসলিম শাসনামলে বাঙালি জাতি ও সমাজ যে বিবর্তন, সংস্কার ও সমন্বয়ের ভেতর দিয়ে গেছে পুরাকীর্তি ও স্থাপত্যগুলো তার গুরুত্বপূর্ণ দলিল। বিশেষত এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে মুসলিম শাসকদের অবদান ও প্রচেষ্টা সম্পর্কে জানতে হলে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো একটি মাইলফলক।’ (সূত্র : সরাসরি সাক্ষাৎকার গ্রহণ)

 

গ. ধর্মীয় গুরুত্ব : বাংলাদেশের মুসলিম স্থাপত্যগুলোর সঙ্গে এ দেশে ইসলামের আগমন ও তার প্রচার-প্রসারের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিশেষত বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইসলাম প্রচারক মুসলিম মনীষীদের মাজার, তাঁদের প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর সঙ্গে ধর্মপ্রাণ মানুষের সে গভীর আবেগ ও শ্রদ্ধা জড়িয়ে আছে তা পর্যটনশিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হতে পারে।

 

ঘ. অর্থনৈতিক গুরুত্ব : দেশের মুসলিম স্থাপত্য ও পুরাকীর্তির ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক মূল্য তুলে ধরার মাধ্যমে স্থানীয় ও বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা গেলে তা পর্যটন খাতে বিপুল সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। কেননা মুসলিম স্থাপত্য ও পুরাকীর্তিগুলোর নির্মাণশৈলী ও নান্দনিকতা, বৈচিত্র্যময় অবকাঠামো, বিস্তৃত পরিসর দেশের অন্যান্য সভ্যতা ও সমাজের পুরাকীর্তির তুলনায় বেশি উজ্জ্বল। বিশেষত মুসলিম দেশগুলোতে মুসলিম পুরাকীর্তির ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক মূল্য তুলে ধরা গেলে তা পর্যটন খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

 

যেভাবে অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে মুসলিম পুরাকীর্তি

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মুসলিম স্থাপত্য ও পুরাকীর্তির সংকট ও সম্ভাবনা বিষয়ে জানতে চাইলে ড. তাজাম্মুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশে পর্যটনকে সেভাবে ঢেলে সাজানো হয়নি। তাই পর্যটন খাতে দেশের স্থাপত্য ও পুরাকীর্তি খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারছে বলে আমি মনে করি না। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান বাণিজ্যিক খাত হিসেবে বাংলাদেশ পর্যটনশিল্পের বিকাশে তার বিপুলসংখ্যক মুসলিম স্থাপত্য ও পুরাকীর্তিকে কাজে লাগাতে পারে। ছোট্ট একটি দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা এসব ঐতিহাসিক নিদর্শন দেশি-বিদেশি গবেষক ও পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারে। এ জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, যোগাযোগ, পরিবেশ-প্রতিবেশের উন্নয়ন ও আবাসিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’