স্বল্প বেতনের চাকরিজীবী মফিজুর রহমান। কাজ করেন রাজধানীর কাঠালবাগানের ফার্ণিচারের দোকানে।পরিবার নিয়ে থাকেন মহাখালীর ওয়্যারলেস গেট এলাকায়। মহাখালী থেকে বাংলামোটরে বাসে ১০ টাকা করে আসা-যাওয়ায় ২০ টাকা খরচ হতো। এখন তা বেড়ে হয়েছে দুই বারে ৩০ টাকা। বাসভাড়াতেই মাসে ৬০০ টাকার খরচ বেড়ে ৯০০ টাকা হওয়ায় তাঁর মাথায় হাত। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন স্বল্প বেতনের এই চাকরিজীবী
নিজের দুঃখের কথা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বাসভাড়া বাড়ল, বাজারে সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, চাল, ডালসহ সব কিছুর খরচ বাড়ল; কিন্তু আমার আয় তো বাড়ল না। এখন সরকার আমাদের বেতনটা বাড়িয়ে দিক।’ তিনি বলেন, ‘বেতন বাড়ানোর কথা বলতে গেলে চাকরিতে ছাঁটাইয়ের মুখে পড়তে হবে। তাই সরকার আমাদের বেতন নির্ধারণ করে না দিলে আমাদের মতো মানুষের বেতন বাড়বে না, এই শহর ছেড়ে একদিন গ্রামে চলে যেতে হবে।’
সরকার জ্বালানি তেলের (ডিজেল ও কেরোসিন) দাম বাড়ানোয় চতুর্মুখী চাপে পড়েছে শফিকুলের মতো কোটি মানুষ। এর অভিঘাত পড়েছে করোনা মহামারিতে ‘নতুন দরিদ্র’ তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষের পাশাপাশি কৃষক, শ্রমিক, উৎপাদক, চাকরিজীবীসহ স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সড়ক পরিবহনের ভাড়া ২৭ শতাংশ এবং নৌপরিবহনের ভাড়া ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধির ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদি। দেশে নতুন করে তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েছে। এই চরম দুর্দিনে গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির ফলে দ্রব্যমূল্য আরেক দফা বৃদ্ধিসহ জীবনযাত্রার সর্বক্ষেত্রে ব্যয় বেড়ে যাবে।
বেসরকারি সংগঠন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০ অনুযায়ী, দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬.৮৮ শতাংশ এবং বিভিন্ন পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়েছে ৬.৩১ শতাংশ। দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির এই ধারা চলতি বছর আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘বাজারে এমনিতেই নিত্যপণ্যের দামে আগুন। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এখন দাবানলে পরিণত হচ্ছে। বাসের ভাড়া বাড়ছে, লঞ্চের ভাড়া বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি পণ্য পরিবহন ব্যয় বাড়ছে। এতে যে যেভাবে পারবে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে। অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি হতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। তাই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি প্রত্যাহার করে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য আমরা দাবি জানিয়েছি।’
দেশে করোনাকালে তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে বলে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) যৌথ জরিপে বলা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত জরিপে বলা হয়েছে, গত ছয় মাসে ৭৯ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। করোনাকালে দারিদ্র্যের কারণে ২৮ শতাংশ মানুষ শহর থেকে গ্রামে চলে যায়। শহর অঞ্চলের মানুষের আয় কোভিডপূর্ব সময়ের তুলনায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে। গ্রামাঞ্চলে এ আয় কমেছে ১২ শতাংশ।
করোনা পরিস্থিতির কারণে ৬২ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছে বলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক এক জরিপে উঠে আসে। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, আয় কমে যাওয়ায় ৫২ শতাংশ মানুষ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। আবার অনেকের ঋণ বেড়েছে। কেউ কেউ সম্পদ বিক্রি করে দিয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে তাদের আয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে ব্যবধান আরো বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ প্রতিবেদন মতে, চলতি অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫.৫৯ শতাংশ, যা আগস্টে ছিল ৫.৫৪ শতাংশ। এই সময় খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৫.২১ শতাংশ, যা আগস্টে ছিল ৫.১৬ শতাংশ। এ ছাড়া খাদ্যবহির্ভূত পণ্যেও মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.১৯ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৬.১৩ শতাংশ। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও পরিবহন ব্যয় বাড়ায় মূল্যস্ফীতি লাগামহীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে এর বহুমুখী প্রভাব পড়ে। গণপরিবহন, কৃষি উৎপাদন, পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায়। এই সুযোগে অনেকে বাড়িভাড়া এমনকি রিকশাভাড়াও বাড়িয়ে দেবে। গত কয়েক মাসে আমরা খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী দেখছিলাম। এখন সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। একই সঙ্গে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অবক্ষয় (বেশি টাকায় কম পণ্য) হবে। একদিকে কম আয়, অন্যদিকে ব্যয় বেশি হওয়ার ফলে জীবনযাত্রার ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়বে।’