যে বিষয়ের যত গুরুত্ব,সে বিষয়ে ততই না মানার নজির !
প্রতিবেদকের নাম :
-
আপডেটের সময় :
বুধবার, ১ জুলাই, ২০২০
-
৫৬
সময় দর্শন
- প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বললেন,“আমি ক্লাশে এত করিয়া ছাত্রদের পড়াইলাম, যে পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়িয়া চন্দ্র গ্রহণ হয়। তাহারা তা পড়িল, লিখিল,নম্বর পাইল,পাস করিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হইল যখন আবার সত্যি সত্যি চন্দ্র গ্রহন হইল তখন চন্দ্রকে রাহু গ্রাস করিয়াছে বলিয়া তাহারা ঢোল ,করতাল, শঙ্খ লইয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল ”। তখন তিনি বললেন,“ইহা এক আশ্চর্য ভারত বর্ষ”।
- রাম রাজ্যে অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় তার স্ত্রী দেবী শীতা বনবাসে থাকায় যজ্ঞের শর্তানুযায়ী শ্রীরাম কে সবাই আরো একটি বিয়ে করতে বললেন । শ্রীরাম সতীত্বের প্রতীক দেবী শীতার মূর্তি পাশে রেখে যজ্ঞ সমাপ্ত করেন। তখন সবাই জয় শ্রীরাম,জয় মা শীতা বলে ধ্বনী দেয়। কারণ পূত-পবীত্রতা ছাড়া যজ্ঞ হয়না। শ্রীরাম সকলকে বুঝিয়ে দিলেন শীতা অপবিত্র নয়। অথচ পরক্ষনেই প্রজারা দেবীর সতীত্ব নিয়ে আবার প্রশ্ন তুললো ! অবাক হলেন শ্রী রাম!
ধর্মীয় কিংবা সাধারণ জ্ঞনের ক্ষেত্রেও অনেক অপসংস্কৃতি আমাদের মধ্যে খুঁটি গেড়ে বসে আছে। যে বিষয়ে যত বেশি গুরুত্ব দিয়ে বলা হয় সে বিষয়ে ততই না মানার নজির সৃষ্টি হয়।
- ইসলাম ধর্মে কবর পূজা,পীর পূজা,মানা-মানত নিষিদ্ধ সত্তেও মাজারগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে এ রকম হাজারো নজির মিলবে। পবিত্র কোরানে অনেক গুরুত্বের সাথে জাকাতের কথা বলা হয়েছে কিন্তু মানছেন কতজন ? অথচ জাকাত না দিলে সমগ্র সম্পদ হবে অপবিত্র। যা ভোগ করা হারাম। এছাড়া মিথ্যা কথা বলতে কোরানে অনেকবার নিষেধ করা হয়েছে কিন্তু শুকুরের মাংশ খেতে বারণ করা হলো একবার। তারপরও মিথ্যাই হলো আমাদের সঙ্গী !
মুসলিম ভাই-বোনেরা নামাজের সময় ভক্তি শ্রদ্ধা নিয়ে যে কালাম তেলাওয়াত করছেন । মুমিন বান্দা ব্যতিরিকে প্রত্যেকে বাস্তব কাজটি করছেন তার উল্টো। কেন ? কারণ নামাজে মনোযোগ নেই।
- অনেক সনাতনীরা অন্য ধর্মের সতীর্থদের স্পর্শকে নাপাকী হিসাবে দেখেন। আর সেটাকে পবিত্র করতে পশুর গোবর ব্যবহার করা হয়েছে। আমার পরিস্কার মনে আছে,তখন আমার বয়স ১০ বছর। আমরা কয়েক বন্ধু রাধা বৈরাগীর গাছ থেকে মাটিতে পড়া আম খেয়ে তার কুয়াতে হাত ধুতেই তিনি লাঠি নিয়ে রাম রাম বলতে বলতে ছুটে এলেন। আর গরুর গোবর পানির সাথে মিশিয়ে কুয়ার চারপাশে ছিটালেন এবং কুয়ার ভিতরেও ফেলে দিয়ে পানির সাথে মিশ্রিত করে দিলেন। এতেই নাকি কুয়াটি পবিত্র হলো। কেউ কি কখনো শুনেছেন শ্রীরাম এমনটি করেছেন ?
- আধুনিক বিশ্বে কুসংস্কার সম্পর্কে সচেতন বিজ্ঞানীরাও কখনো এর ভিত্তি খুঁজে পাননি। যেমনটি ঘটেছে ভারতে। মহামারী করোনা থেকে বাঁচতে এখানকার কতিপয় অধিবাসী গরুর গোবর কিংবা গোমূত্র সেবন করছে ! তারা গরুকে দেবতা মানছে আর তার মল,মুত্র করোনার প্রতিষেধক ভাবছে ! বিজ্ঞানীরা অবাক দৃষ্টিতে দেখছেন তাদের এ সব অন্ধ বিশ্বাস।
- জনপ্রতিনিধিরা শপথ নিচ্ছেন এই বলে যে,‘‘কারো প্রতি রাগ,অনুরাগ বা ব্যক্তি স্বার্থের বশবতী হয়ে কোনো কাজ করবো না,….দেশের সংবিধান সমুন্নত রাখবো ”। প্রকৃত পক্ষে হচ্ছেটা কি ? অথচ শপথ ভঙ্গ হলে তার আর ওই পদে থাকার বৈধতা থাকে না । আমাদের দেশে অন্তত তার একটিরও নজির নাই।
- পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের পরামর্শ দেন তারা যেনো ইভ টিজিং না করে। নেশাজাত দ্রব্য সেবন না করে। অনৈতিক কাজের সাথে জড়িত না হয়, ইত্যাদি। সেই ছেলেই সিগারেটে ফুঁক দিচ্ছে। ক্লাশে না যেয়ে মেয়েদের পিছনে দৌড়াচ্ছে। অনেকে মাদকের সাথেও জড়িয়ে পড়ছে ! কেন ?
- মায়ের কাছে গল্প শুনতাম,দাদীরা নাকী নদীতে গোসল করে আসতে বট গাছে জটা সন্যাসি দেখতেন ! তার মুখ দিয়ে আগুন পড়তো। যিনি দেখতেন তার কোলের শিশুরা আর বাঁচতো না,কুকড়ে,মুচরে মরে যেত। যাকে বলা হচ্ছে ধনুষ্টংকার।
তখন সবারই ধারণা এরা হলো দেও ! অনেকে একে রোগ-বালাই বলতেন। যখন কলেরায় মানুষ মরে গ্রাম শূণ্য হয়ে যেত তখনও মানা-মানত করা হতো। কলেরা কি কারণে হতো তা এখন সবাই জানে,দূষিত পানি খেলেই কলেরা হয়। আবার এটাও জানে ওই পানি ফুটিয়ে খেলে আর কলেরা হয়না।
- ধনুষ্টংকার হলেও একই রকম ভাবনা সৃষ্টি হতো। অনেকেই মনে করতো ভুতে ধরেছে। অথচ একটি টিটিনাস ইঞ্জেকশন নিলে আর ধনুস্টংকার হয়না। এখন তো কেউ ইঞ্জেকশন নিতে চায়না । তার পরিবর্তে জীবানুনাশক দিয়ে পরিস্কার করেই ধনুষ্টংকার মোকাবেলা করছে। সেখানে আগের যুগের মানুষের অজ্ঞতা বশত: এ সব রোগ থেকে বাঁচতে মানা,মানত,ভোগ কত কিছু দিয়েও রক্ষা পায়নি।
- সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে আমাদের সমাজে (বিশেষ করে প্রসূতি মাদের বিষয়ে) অনেক কুসংস্কার ও ভুল বিশ্বাস প্রচলিত আছে। যেমন:
– এ সময় কোন কিছু খেতে নেই। বলা হয়, সূর্যগ্রহণের ১২ ঘণ্টা এবং চন্দ্রগ্রহণের ৯ ঘণ্টা আগে থেকে খাবার গ্রহণ করা বারণ!
– এ সময় তৈরি করা খাবার ফেলে দিতে হবে!
– এ সময় যৌন সংসর্গ করা যাবে না!
– গর্ভবতী মায়েরা এ সময় যা করে, তার প্রভাব সন্তানের ওপর পড়বে!
– সূর্যগ্রহণে গর্ভবতী মায়েদের কাত হয়ে শুতে বারণ নইলে নাকি গর্ভের শিশু বিকলাঙ্গ হয়!
– সূর্যগ্রহণের সময় জন্ম নেওয়া শিশুদের ব্যাপারে দুই ধরনের গপ্প শুনতে পাওয়া যায়। এক, শিশুটি অসুস্থ হবে এবং দুই, শিশুটি চালাক হবে!
– প্রসূতি মা সূর্যগ্রহণ দেখলে তার অনাগত সন্তানের বিকলঙ্গ হবে!
– চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণের সময় যদি গর্ভবতী নারী কিছু কাটাকাটি করেন, তাহলে গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতি হয়—এ গুলো সবই কুসংস্কার ও ভুল বিশ্বাস।
– এ সময় কোনো নারীকে ঘুম বা পানাহার থেকে বারণ করাও অন্যায়।
এছাড়া গর্ভবতী নারীর করণীয়-বর্জনীয় বিষয়ে সমাজে বহু কিছু প্রচলিত রয়েছে সেগুলো সব কুসংস্কার এবং ভ্রান্ত ধারণা।আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমীন। ইসলামী শরিয়াহ ও বাস্তবতার সঙ্গে এগুলোর কোনো মিল নেই এবং বৈজ্ঞানিকভাবেও গ্রহণযোগ্য নয়।
জাহেলি যুগেও এ ধরণের কিছু ধারণা প্রচলিত ছিল। সেকালে মানুষ ধারণা করত যে, চন্দ্রগ্রহণ কিংবা সূর্যগ্রহণ হলে অচিরেই দুর্যোগ বা দুর্ভিক্ষ হবে। চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণ পৃথিবীতে কোনো মহাপুরুষের জন্ম বা মৃত্যুর বার্তাও বহন করে বলে তারা মনে করত। বিশ্বমানবতার পরম বন্ধু, মহান সংস্কারক, প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেগুলোকে ভ্রান্ত ধারণা হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
- করোনার ক্ষেত্রেও কি মানুষ কুসংস্কারকেই বেছে নিবে ? করোনার প্রতিষেধক নাই কিন্তু কি করলে করোনা প্রতিরোধ করা যায় তা তো মানুষ জানে । সাবান দিয়ে হাত ধোয়া,মাস্ক ব্যবহার,সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা,হোমকোয়ারেন্টাইন প্রভৃতি সম্পর্কে সচেতন থেকেই কেবল করোনা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। কিন্তু অনেকে আল্লাহ ভরসা বলে কিছুই মানছে না। চোর-ডাকাতরাও নাকি বিপদে পড়লে অনেকবার আল্লাকে ডাকে। তাই বলে কি আল্লাহ তাদের জামিনদার হবেন ? কখনোই নয় ! রাসুল(সা:) মহামারী সম্পর্কে যা বলেছেন সেটাও মানছেনা। তাহলে আল্লাহ ও তার রাসুল সম্পর্কে তাদের ঈমান কত শক্ত তা সহজেই অনুমান করা যায়। তাই ঈমানদার মানুষের দায়িত্ব কেবল আল্লাহ নেন। রাসুল (সা: ) এটাও বলেছেন,ঈমানদার ব্যক্তিগণের দোয়াই হচ্ছে মহামারী ধ্বংসের মুল অস্ত্র”। তাহলে প্রশ্ন আসে পৃথিবীতে কি ঈমানদার ব্যক্তি নাই ! যার দোয়া আল্লাহ পাক শুনবেন এবং করোনাকে তুলে নিবেন !
- যিনি পাপ করেন আর যিনি সহেন উভয়েই সমান অপরাধী। আমাদের মধ্যে বিশ্বাস আছে কিন্তু ভক্তি নেই। আবার যাকে ভক্তি করি সেখানে আল্লাহর রহমত নেই। আমরা অনেকেই হাদিস-কোরান,নামাজ বাদ দিয়ে ফেসবুকে যতসব কারবার করছি। আল্লাহর কাছে যে ভাবে প্রার্থনা করার কথা সেভাবে না করে ফেসবুকের প্রার্থনাই যেন সকল বিপদ-আপদ তথা করোনাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব মনে করছি ! এমন ভাবনায় ডুবে আছি আমরা যার ফলে আল্লাহ-রাসুলের পথ থেকে অনেক দূরে চলে গেছি ।
মহান আল্লাহ রাসুল(সা:)কে শিক্ষা দিলেন কোরান। তিনি কোরান এবং তার বানী তথা হাদিস রেখে গেলেন তার উম্মতের জন্য। কোরান এবং হাদিসের উপর আমরা বিশ্বাস রাখি কিন্তু ভক্তিভরে মানি এবং পড়ি কতজন ? আর তা পড়লেও বুঝি কতজন ?
আল্লাহপাক স্বয়ং যা নিষেধ করেছেন তাও আমরা করছি আবার মহানবী (সা:) যা করতে বলেছেন তাও আমরা করছিনা। অথচ আল্লাহ এবং তার রাসুলের প্রতি আমরা ঈমান এনেছি।
তাই এখনো সময় আছে নিজের ভুল স্বীকার করে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। আল্লাহর কাছে করা সকল ভুল তিনি মাপ করে দিতে পারেন কিন্তু বান্দার কাছে করা ভুল তিনি ক্ষমা করবেন না। তাই নিজেদের দ্বারা কার্যত সকল ভুল নিস্পত্তি করে প্রত্যেককে তার প্রাপ্য ফিরিয়ে দিয়েই কেবল ক্ষমা পাওয়া যেতে পারে। নইলে করোনার মত প্রাণঘাতি মহামারী বার বার এসে আমাদের আঘাত করতে থাকবে।
- আল্লাহতায়ালা ও প্রিয় নবী করিম (সা.) কুসংস্কারজনিত বিশ্বাসকে হারাম বলে অভিহিত করেছেন। সব মঙ্গল-অমঙ্গলের শক্তি ও ক্ষমতার মালিক একমাত্র আল্লাহতায়ালা এই ইমান ও বিশ্বাসের প্রতি মোমিন মুসলমানের সুদৃঢ় আস্থা থাকতে হবে।।
।। মাহবুব-উল-আলম।।
Please Share This Post in Your Social Media
এই বিভাগের আরও খবর